আপেল মাহমুদ হলেন একজন বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী।তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” গানের গায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এ ছাড়াও “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর” তার একটি উল্লেখযোগ্য গান। দেশাত্ববোধক গান ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনগীতি, গণসঙ্গীত ও আধুনিক ধারার গান গেয়েছেন।
আপেল মাহমুদ
আপেল মাহমুদ ১৯৪৭ সালের ২২ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার ( হোমনা/ দাউদকান্দি) সোনারচর গ্রামের বাসিন্দা প্রকৌশলী এমএ রহমান ও আমিনা রহমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং জুন মাস পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেছেন। এরপর তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে যোগ দেন।
শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি কুমিল্লার আওয়ার লেডি অব ফাতিমা গার্লস হাই স্কুলে। তারপর কিছুদিন ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল। সেখান থেকে ৮ম শ্রেণিতে কুমিল্লা জিলাস্কুলে ভর্তি হন। মেট্রিক পাশ করেন এ স্কুল থেকেই। এ সময় পিতার আকষ্মিক মৃত্যুতে কুমিল্লা ছেড়ে যান মায়ের কর্মস্থল নরসিংদীতে। তারপর ঢাকার কায়েদে আজম মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সংগীতে হাতে খড়ি হয় কুমিল্লা জিলা স্কুলে অধ্যয়নের সময়ে । কুমিল্লার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করায় সমগ্র শহরে পরিচিতি বাড়তে থাকে। কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে ১৯৬১ সালে প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় স্কুল পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন। ৮ম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় প্রথমবারের মত ঢাকা কলেজে অনুষ্ঠিত প্রদেশ ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে তিনটি স্বর্ণপদক পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন।
আপেল মাহমুদ বিভিন্ন সময়ে ডাঃ মোঃ মুতরীব, ওস্তাদ সুখেন্দু চক্রবর্তী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ মুন্সী রইস উদ্দিন প্রমুখ সংগীত সাধকগণের কাছে সংগীতের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তালিম নেন।
মা আমেনা রহমান হাওয়াই গীটার বাজাতেন। বড় বোন ও ভাই নিয়মিত গান শিখতেন। তাদের দেখেই আগ্রহী হন সংগীতের প্রতি। বাবার মৃত্যুর পর ও মায়ের চাকরির কারণে প্রিয় শহর কুমিল্লা ছেড়ে যান নরসিংদীতে। সে সময় দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আপেল মাহমুদ সেখান থেকে চলে যান ভারতে। প্রথমে আগরতলা ও পরে কোলকাতা।
ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে প্রত্য যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ভৈরব, আশুগঞ্জ, আজমীরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, তেলিয়াপাড়া এসব স্থানে সংগঠিত যুদ্ধে আপেল মাহমুদ সাহসিকতার সাথে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ।
যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি বেতার কেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশবাসীকে উদ্দীপিত করার তাগিদ অনুভব করে আপেল মাহমুদকে এর সাথে সম্পৃক্ত করেন। আপেল মাহমুদ প্রথমে আগরতলার কয়েকটি শিবিরে গণসংগীত ও প্রেরণাদানকারী সংগীত পরিবেশন করে সকলের দৃষ্টিতে পড়েন।
এরপর শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ। আপেল মাহমুদ সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। তিনি সেখানে শুধু শিল্পী নন, একটি যুদ্ধরত জাতির জন্যে বেতার কেন্দ্রের ভূমিকার বিষয় উপলব্ধি করে প্রতিনিয়ত প্রেরণামূলক সংগীত রচনা, সুরারোপ ও পরিবেশনার দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে তিনি গোবিন্দ হালদারের লেখা “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” গানে কণ্ঠ দেন। এছাড়া তিনি তার নিজের লেখা “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর” গানে কণ্ঠ দেন। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে তার গাওয়া গান নিয়ে জি-সিরিজ থেকে প্রকাশিত হয় আলতাফ মাহমুদ দ্য লিজেন্ড অ্যালবাম।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিনোদন সাংবাদিক সমিতি (বাবিসাস) আজীবন সম্মাননা পান।
আরও দেখুনঃ