Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু [ Ustad Abdul Aziz Bacchu ]

আবদুল আজিজ বাচ্চু : বিদগ্ধ সংগীতসাধক ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলার কাজীহাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রফিউদ্দিন আহমেদ। পেশায় তিনি ছিলেন কোর্ট সুপারিনটেনডেন্ট। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল চতুর্থ। পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে শৈশব কাটে ময়মনসিংহ জেলায়। সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর আবারো ফিরে আসেন রাজশাহী শহরে। ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তির সময় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ওপার বাংলা থেকে এই ভূমিতে স্থায়ীভাবে চলে আসেন বিশিষ্ট সংগীতগুণীজন ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন।

সে সময় আবদুল আজিজ বাচ্চু উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়ন করতেন। কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে সংগীতের প্রতি সৃষ্টি হয় তার প্রচণ্ড অনুরাগ। ফলশ্রুতিতে রাজশাহীর ষষ্ঠীতলা নিবাসী ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের কাছে নেন সংগীতের হাতেখড়ি এবং শুরু হয় তাঁর নিরলস কঠোর সাধনা। মজার ব্যাপার যে, সংগীতগুরুর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংগীতবিষয়ক তালিম গ্রহণের জন্য তিনি আর কারো দ্বারস্থ হননি। এরই মধ্যে তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে সম্পন্ন করেন স্নাতক ডিগ্রি।

এরপর ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ রাজশাহী শহরকে আন্দোলিত করলে তিনি গণসংগীত পরিবেশন করে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের মমত্ববোধকে উজ্জীবিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।

বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় স্বীকৃত হলে আবদুল আজিজ বাচ্চু তাঁর গুরু ভাইদের সঙ্গে নিয়ে ওস্তাদজি মোজাম্মেল হোসেনকে কেন্দ্র করেই সে সময় প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়’। নতুন উদ্যমে মনোনিবেশ করেন সুরের সাধনায়। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগের কারণে প্রতি বৃহস্পতিবার নিয়ম করে সারারাত ধরে চলত তাঁর একনিষ্ঠ দরবারি রাগচর্চা। শেষ জীবন পর্যন্ত এই চর্চা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী বেতারের সংগীত প্রযোজক এবং গণসংগীতশিল্পী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একাত্ম হন। তাঁর সুর ও সংগীত পরিচালনায় ‘আঁধারের বুক চিরে ছিনিয়ে আনা সূর্য…’ সে সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে উজ্জ্বল করে তুলেছিল। এ গানটির জন্য তাঁকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয়। সংগীতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ‘শিল্পকলা একাডেমী’ পদক, ‘বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী সংস্থা’ পদক, ‘রাজশাহী প্রেসক্লাব’ পদকসহ বহু পদক ও পুরস্কার অর্জন করেন।

বিভিন্ন সময় তিনি নতুন কুঁড়িসহ নানান সংগীত প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, আন্তস্কুল ও কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সম্মানিত বিচারকের পদ অলংকৃত করেন। সংগীত সাধনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন জাতীয় টিমের একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়। সংগীতবিষয়ক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়েছিল। শুদ্ধ সংগীত সাধনায় ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু ছিলেন আপসহীন সুরের সৈনিক।

স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মলাভের পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রকৃত অর্থে তিনি সাধক কারিগরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এদেশের খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, মো. রফিকুল আলম, রিজিয়া পারভীন, এম এ খালেক, ইফফাত আরা নার্গিস, লোকমান হাকিম, এইচ এম রফিকসহ অনেক গুণী শিল্পী তৈরির কারিগর ছিলেন তিনি। লালনগীতির কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীন এবং শিল্পী দিলরুবা খান অল্প কিছুদিন তাঁর কাছে তালিম গ্রহণ করেন। সংগীতগুরু ওস্তাদ মোজ্জাম্মেল হোসেনের শেষ ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁরই সুযোগ্য পুত্র ওস্তাদ রবিউল হোসেনকেও তিনি তালিম প্রদান করেন।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এন্ড্রু কিশোর [ Andrew Kishore ]
ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু তার শিশ্যদের মধ্যে অন্যতম সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, যিনি ওস্তাদের সৃতি রক্ষায় অনেক কিছু করেছেন। তিনি ওস্তাদের নামে রাজশাহীতে ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছিলেন। তিনি নিজেই সেই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে পরিচালনা করে আসছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য তিনি প্রায় প্রতি মাসেই রাজশাহী যেতেন। এমনকি শারীরিক পরিস্থিতি একটু খাবার হবার পরেও প্রতি ৩ মাসে একবার যেতেন। এন্ড্রু কিশোরের নিজের উদ্যোগেই নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। মৃত্যুর আগে যখন এন্ড্রু কিশোর কথা বলতে পারতেন, সে সময় তিনি ওই সংগঠনের সভাপতিত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর বাল্যবন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাসের হাতে।

বর্ণাঢ্য সংগীত কর্মজীবনের শেষদিকে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উপমুখ্য সংগীত প্রযোজক পদোন্নতি নিয়ে রংপুর বেতারে বদলি হয়ে যান এবং ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে মুখ্য সংগীত প্রযোজক পদোন্নতি নিয়ে আবার তাঁর প্রিয় শহর রাজশাহীর বেতার ভবনে কর্মে যোগদান করেন। ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্র থেকে অবসরগ্রহণ করেন। ভারতের সংগীতভুবনের জনপ্রিয় শিল্পী পৃথা মজুমদার এবং তাঁর বড় বোন স্মৃতিকণা মজুমদার শৈশব থেকে এই সুরসাধকের কাছে পরিশীলিত ও শুদ্ধ সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন।

বাংলাভূমির শিল্পী গড়ার মহান কারিগর ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর ৬৯ বছর বয়স পূর্ণ করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। পদ্মানদী বিধৌত বিভাগীয় শহর রাজশাহী তথা বাংলাদেশের সংগীতভুবনে ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শুদ্ধ সুরের বিদগ্ধ সাধক। সুরের ভুবনে তাঁর বিচরণ ছিল পেখম তোলা ময়ূরের মতো বর্ণিল, নান্দনিক ও আনন্দলোকের মতো।

ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু [ Ustad Abdul Aziz Bacchu ]

আরও পড়ুন:

 

Exit mobile version