আবদুল করিম শাহ । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক

আবদুল করিম শাহ হচ্ছেন একজন বাংলাদেশী কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক। তিনি বাউল সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কর্মজীবনে তিনি পাঁচশো-এর উপরে সংগীত রচনা করেছেন। বাংলা সঙ্গীতে তাঁকে “বাউল সম্রাট” হিসাবে সম্বোধন করা হয়। তিনি বাংলা সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০১ সালে একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন।

আবদুল করিম শাহ । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক

প্রাথমিক জীবন

আবদুল করিম শাহ ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজানের ঘরে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খুব ছোটবেলায় তার গুরু বাউল শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশ থেকে সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। তিনি আফতাব-উন-নেসা কে বিয়ে করেন, যাকে তিনি সরলা নামে ডাকতেন। তিনি ১৯৫৭ সাল থেকে তার জন্মগ্রামের পাশে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোন কিছু তাকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি বাউলগানের দীক্ষা লাভ করেছেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।

সঙ্গীত সাধনা

স্বশিক্ষিত বাউল আবদুল করিম শাহ এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।

আবদুল করিম শাহ । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক

বাউলসাধক আবদুল করিম শাহ জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা তিনি কখনোই গ্রহণ করেননি। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে জীবন্ত কিংবদন্তীঃ বাউল শাহ আবদুল করিম নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে।

এই অ্যালবামের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ তার বার্ধক্যজনিত রোগের চিকি‍ৎসার জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়। ২০০৭ সালে বাউলের জীবদ্দশায় শাহ আবদুল করিমের জীবন ও কর্মভিত্তিক একটি বই প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়, ‘শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন-গ্রন্থ’ (উৎস প্রকাশন) নামের এই বইটি সম্পাদনা করেন লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক সুমনকুমার দাশ।

শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী ২০০৯ সালের ২২ মে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি ড. জাফর আহমেদ খানের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গ্রন্থ ‘শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র’ প্রকাশিত হয়। বইটির পরিবেশক বইপত্র।

প্রকাশনা

বাউল আবদুল করিম শাহর এ পর্যন্ত ৭টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তার রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়াও সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আব্দুল করিম স্মারকগ্রন্থ (অন্বেষা প্রকাশন) তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।

আবদুল করিম শাহ । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক

এর আগে-পরে আবদুল করিম শাহকে নিয়ে সুমনকুমার দাশের ‘বাংলা মায়ের ছেলে : শাহ আবদুল করিম জীবনী’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘সাক্ষাৎকথায় শাহ আবদুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘শাহ আবদুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম’ (উৎস প্রকাশন), ‘গণগীতিকার শাহ আবদুল করিম’ (উৎস প্রকাশন) প্রকাশিত হয়। সর্ব শেষ ২০১৬ সালে ঢাকার প্রখ্যাত প্রকাশনাসংস্থা প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয় সুমনকুমার দশের ‘শাহ আবদুল করিম : জীবন ও গান’ বইটি।

এ বইটি ইতোমধ্যেই একটি প্রামণ্য জীবনী হিসেবে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। এ বইটিতে করিমের নির্বাচিত বেশ কিছু গানও সংকলিত হয়েছে। শাহ আবদুল করিমের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস সাইমন জাকারিয়া রচিত “কূলহারা কলঙ্কিনী” প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে।

সম্মাননা

বাউল আবদুল করিম শাহ ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ভাটির পুরুষ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এছাড়াও সুবচন নাট্য সংসদ তাকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের ৮৮টি প্রদর্শনী করেছে।

আবদুল করিম শাহ । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক

  • একুশে পদক (২০০১)
  • কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক (২০০০)
  • রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০)
  • লেবাক এ্যাওয়ার্ড (২০০৩)
  • মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪)
  • সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫)
  • বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬)
  • খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮)
  • বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা (২০০৮)
  • হাতিল এ্যাওয়ার্ড (২০০৯)এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯)

মৃত্যু

২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট আবদুল করিম শাহ মৃত্যু বরণ করেন। সেই দিন শনিবার সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আব্দুল করিমকে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর থেকেই লাইফসাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment