আবদুল গাফফার চৌধুরী । বাঙালী গ্রন্থকার, কলাম লেখক

আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন একজন বাংলাদেশী গ্রন্থকার, কলাম লেখক। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো-এর রচয়িতা। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয়বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক ও ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী । বাঙালী গ্রন্থকার, কলাম লেখক

জন্ম ও বংশ

আব্দুল গাফফার চৌধুরী ১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ মহকুমার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে একটি বাঙ্গালী মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যারা উলানিয়ার চৌধুরী বংশ হিসাবে পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুষ শায়খ মহম্মদ আসাদ আলী পারস্য থেকে ভারতবর্ষের অযোধ্যা শহরে আসেন তারপর চলে যান বাংলার মুর্শিদাবাদে।আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সম্পূর্ণ নাম হলো: আব্দুল গাফফার চৌধুরী ইবনে ওয়াহেদ রাজা চৌধুরী ইবনে ফজেল আলী ইবনে নয়া রাজা ইবনে মহম্মদ তকি।

তাঁর বাবা ছিলেন হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। পাঁচ বোন হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। তিনি লন্ডন প্রবাসী ছিলেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী । বাঙালী গ্রন্থকার, কলাম লেখক

শিক্ষাজীবন

আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে।

সেসময়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্কসবাদী দল আরএসপি’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো।

আবদুল গাফফার চৌধুরী । বাঙালী গ্রন্থকার, কলাম লেখক

কর্মজীবন

১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদীর’ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন।

১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক ‘জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং অণুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দু’বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল।

১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে’। ১৯৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।

আবদুল গাফফার চৌধুরী । বাঙালী গ্রন্থকার, কলাম লেখক

 

পুরস্কার ও সম্মাননা

  • ইউনেস্কো পুরস্কার ( ১৯৬৩)
  • বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭)
  • একুশে পদক (১৯৮৩)
  • বঙ্গবন্ধু পুরস্কার
  • সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক ২০০৮, লন্ডন
  • স্বাধীনতা পদক ২০০৯
  • মানিক মিয়া পদক ২০০৯
  • যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি
  • সংহতি আয়োজিত প্রবাসীদের পক্ষ থেকে সংবধর্না, ঢাকা ২০০৯

জীবনাবসান

আবদুল গাফফার চৌধুরী ২০২২ সালের ১৯ মে (সকাল ৬:৪৯ মিনিটে) লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তাঁর মরদেহ দেশে আনা হয় ২১ মে এবং এদিন দুপুর ১:১৩ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে তাঁকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। পরে ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশে তাকে করব দেওয়া হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment