ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনপ্রিয় গায়ক, সুরকার ও অভিনেতা জুবিন গার্গ আর নেই। শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং দুর্ঘটনায় ৫২ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্থানীয় হাসপাতালে তাঁকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে শোকাহত আসামসহ সমগ্র ভারতবর্ষ, বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চল।
জন্ম ও শৈশব
১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর মেঘালয়ের তুরা শহরে জন্ম নেন জুবিন। তাঁর বাবা মোহিনী এম. বরঠাকুর পেশায় মেজিস্ট্রেট ছিলেন এবং কবিতা লিখতেন ‘কপিল ঠাকুর’ নামে। মা ইলি বরঠাকুর ছিলেন একাধারে নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী ও গায়িকা। শৈশবে মায়ের কাছ থেকেই জুবিন প্রথম সংগীতের হাতেখড়ি নেন। তাঁর ছোট বোন জংকি বরঠাকুরও গায়িকা ও অভিনেত্রী ছিলেন; ২০০২ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় জংকির অকাল মৃত্যু হলে জুবিন তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে “শিশু” নামের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন।
জুবিনের শৈশব কেটেছে শিবসাগর, গুয়াহাটি ও আসামের নানা জেলায়। প্রথাগত পড়াশোনা চালালেও শেষ পর্যন্ত সংগীতেই তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
সংগীতজীবনের সূচনা
১৯৯২ সালে যুব মহোৎসবে পাশ্চাত্য একক পরিবেশনে স্বর্ণপদক জিতে আলোচনায় আসেন জুবিন গার্গ। একই বছরে মুক্তি পাওয়া তাঁর প্রথম অসমীয়া অ্যালবাম “অনামিকা” বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কেবল অসমীয়া নয়, বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, নেপালি, মারাঠি, ওড়িয়া, খাসি, কারবি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, বোরোসহ ৪০টিরও বেশি ভাষায় তিনি ২০ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন।
বলিউডে সাফল্য
বলিউডে তাঁর কণ্ঠ প্রথম শোনা যায় নব্বইয়ের দশকে। তবে বড় সাফল্য আসে ২০০৬ সালের গ্যাংস্টার চলচ্চিত্রের গান “ইয়া আলি” দিয়ে। গানটি জুবিনকে সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পরে ফিজা, কাঁটে, ক্রিশ ৩, পেয়ার কে সাইড এফেক্টস, নমস্তে লন্ডন, দ্য ট্রেন, ঝুম বারাবার ঝুম সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি কণ্ঠ দেন। বাংলা চলচ্চিত্র শুধু তুমি–এর জন্য সেরা সঙ্গীত পরিচালক পুরস্কারও অর্জন করেন।
চলচ্চিত্র ও অন্যান্য কাজ
গান ছাড়াও জুবিন গার্গ নিজেকে চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা ও প্রযোজক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া তুমি মোর, মাথো মোর ছবিতে তিনি কাহিনীকার, পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে একসঙ্গে কাজ করেন। ২০০৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী দীনবন্ধু ছবিতে সহ-পরিচালনা ও অভিনয় করেন।
পরবর্তী সময়ে মিশন চাইনা (২০১৭) ও কাঞ্চনজঙ্ঘা (২০১৯) চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের দর্শকের মন জয় করেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু আসামে নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও বিদেশেও মুক্তি পায়।
ব্যক্তিজীবন
২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার গরিমা শইকিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। গানের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। আসামের তরুণ শিল্পীদের জন্য নিজের সংগীত স্কুল ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গড়ে তুলেছিলেন।
অসমে জাতীয় শোক
জুবিন গার্গের মৃত্যুতে আসাম সরকার ঘোষণা করেছে, শেষকৃত্যের আগ পর্যন্ত রাজ্যের সব স্কুলের পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামাঞ্চলের মানুষ পর্যন্ত শোকে ভেঙে পড়েছে। রাস্তায় মোমবাতি জ্বালিয়ে, তাঁর গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে মানুষ। অনেকের চোখে এই মুহূর্তে জুবিন গার্গকে ভূপেন হাজারিকার পর দ্বিতীয় জাতীয় আইকন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গায়ক, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী, অভিনেতা ও পরিচালক—সব ভূমিকায় সমান দক্ষ জুবিন গার্গ প্রমাণ করেছিলেন শিল্পীর পরিচয় ভাষা ও ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। তাঁর অকাল প্রয়াণে ভারতের সাংস্কৃতিক ভুবনে তৈরি হয়েছে এক অমোচনীয় শূন্যতা।