ওস্তাদ ইনায়েত খান [ Ustad Enayat Khan, Sitarist & Surbhararist ] : যুগান্তকারী সেতারশিল্পী ও সাধক সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ইনায়েত খান বা ইনায়েত খাঁ, ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন, ভারতের পশ্চিম উত্তর প্রদেশ রাজ্যের যমুনা নদীর তীরের শহর এটাবাহ বা ইটাওয়াতে জন্মগ্রহণ করেন।
ওস্তাদ ইনায়েত খান পিতা, স্বনামখ্যাত ওস্তাদ ইমদাদ খাঁর কাছেই, তাঁর সংগীতে হাতেখড়ি হয়। দীর্ঘ বিশ বছর পর পিতার স্নেহছায়ায় কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, নিরলস চর্চা আর গভীর ভালোবাসায় কণ্ঠসংগীতের সূক্ষ্ম কারুকাজের শিক্ষালাভ করেন। এরপর বীণা বাজাতে শুরু করেন ওস্তাদ ইনায়েত খান। তার পাশাপাশি সুরবাহার বাদ্যযন্ত্রের তালিম নিতে থাকেন।
ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও উদার প্রকৃতির মানুষ। ষোলো বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং চার সন্তানের জনক হন তিনি। স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও সেই স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া দুই পুত্রের অকালমৃত্যু ঘটে। সংসার-ধর্মে উদাসীন ইনায়েত খাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটলে এক বছর তিনি ইন্দোরের রাজদরবারে সভাবাদক পদে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর তিনি কলকাতা গমন করেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। কলকাতায় থাকাকালে কিছুদিন পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে সভাবাদকের পদ অলংকৃত করেন।
ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেতারশিল্পী। তাঁর মতো অভাবনীয় প্রতিভাবান সেতার ও সুরবাহার শিল্পী এককথায় বিরল। তিনি ইন্দোর, বরোদা, গৌরীপুর, ভুপাল, রামগোপালপুর ও ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার রাজদরবারে সংগীত পরিবেশন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। এরই সূত্র ধরে সংগীতশিল্পী এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের মহান পৃষ্ঠপোষক ময়মনসিংহ গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সঙ্গে ইনায়েত খার ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁর সভায় তিনি দরবারি সংগীতশিল্পী হিসেবে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
সে-সময় জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোরের দরবারে ভারতবিখ্যাত সরোদশিল্পী ওস্তাদ আমির খাঁ, স্বনামখ্যাত এস্রাজশিল্পী শীতলপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং প্রসিদ্ধ ধ্রুপদ ও টপ্পা গায়ক বিপিনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও উপস্থিত থাকতেন। জমিদার বাবুর আমন্ত্রণে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ সপরিবারে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে চলে আসেন। এখানেই ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কন্যা শরীফন বিবি এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মাষ্টমীর দিন স্বনামখ্যাত পুত্র বিলায়েত খাঁর [ Ustad Vilayet Khan, Sitarist ] জন্ম হয়। ব্রজেন্দ্রকিশোরের সুযোগ্য পুত্র বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তাঁর কাছে সুরবাহার এবং সেতার শিক্ষা লাভ করেন।
প্রথিতযশা সংগীতগুণীজন ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ পিতার কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করে একজন বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন শিল্পী হলেও তাঁর চিত্ত সবসময় সুরলোকে বিচরণ করত। তাই তিনি রাগের বিশুদ্ধতার পরিবর্তে কাফি রাগে তীব্র মধ্যম এবং ভুপালিতে শুদ্ধ মধ্যম প্রয়োগ করে রাগের সৌন্দর্যবর্ধন করেন। তাঁর ঘরানার গৎ-তোড়া আর গানের কাঠামো বিভিন্ন মসিদখানি ও রেজাখানি চালে রচিত। বিদ্যুৎসম সপাট তানের শেষে বিভিন্ন প্রকারের উপযুক্ত তেহাইয়ের সংযোজন তাঁর বাদনের এক অপূর্ব কৌশল।
ওস্তাদ এনায়েত খাঁ সাহেব কে নিয়ে কথা বলেছেন তার সন্তান ওস্তাদ বিলায়েত খান:
ওস্তাদ ইনায়েত খানের সমস্ত তান ও তেহাই ছিল যেন তবলা ও পাখোয়াজের বোলের ফর্মায় প্রস্তুত। সুরবাহার ও সেতারযন্ত্রে স্ফুরিত গমকের কাজ ছিল অনন্য। সংগীত দিয়ে মানুষের চিত্তকে মোহিত করার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। কলকাতায় সুরবাহার ও সেতারের বহুল প্রচারে সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ইনায়েত খাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, তখন রেকর্ডিং প্রযুক্তি এতটা ভালো না হওয়ায় সেই সঙ্গীত তেমনভাবে রেকর্ড করে রাখা সম্ভব হয়নি। অবশ্য যেটুকু রেকর্ড আছে তাতে কল্পনাশক্তি দিয়ে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে ওস্তাদ এনায়েত খান আসলে কেমন বাজাতেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের কুশলী সেতারশিল্পী হিসেবে ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ ছিলেন এক বিরল প্রতিভা। সংগীত বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই তিনি পরিপূর্ণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে সুযোগ্য পুত্র বিলায়েত খাঁকে সঙ্গে করে তিনি এলাহাবাদ গমন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রচণ্ড শীত সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়লে কাঙ্ক্ষিত সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ।
পিতার পরিবর্তে ১১ বছরের পুত্র বিলায়েত খাঁ ওই সম্মেলনে সেতার বাজিয়ে উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দকে চমৎকৃত করেন। পিতার অসুস্থতায় কালবিলম্ব না করে পুত্র বিলায়েত খাঁ দ্রুত কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। গাড়িতে রোগের প্রাবল্যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সুচিকিৎসা সত্ত্বেও তাঁর জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। অসুস্থ অবস্থাতেই রাত প্রায় একটার দিকে এই মহান সুরস্রষ্টা ঢলে পড়েন চিরনিদ্রার কোলে।
বর্তমানে সেতার বাদ্যযন্ত্রের বহুল প্রচারের মূলে ওস্তাদ ইনায়েত খাঁর অবদান বিশেষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে জমিদারপুত্র বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, জ্ঞানদাকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী ও নীরদাকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী, জীতেন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, জ্যোতিষচন্দ্র চৌধুরী, জন গোমেশ, পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশী (ডি.টি. যোশী), বিপিনচন্দ্র দাস, শ্রীনিবাস, বিমলাকান্ত রায় চৌধুরী, অমিতকান্তি ভট্টাচার্য, রেণুকা সাহা এবং ওস্তাদজির দুই সুযোগ্য পুত্র ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ ও ওস্তাদ ইমরাত খাঁ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।