শাহ মোহাম্মদ ইবরাহীম আলী তশনা একজন মুসলিম চিন্তাবিদ, ইসলামী পণ্ডিত সমাজ-সংস্কারক, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী খিলাফত আন্দোলন-এর অন্যতম নেতা এবং বাঙলা-উর্দু-ফারসি সহ বহুসংখ্যক মরমি সঙ্গীতের রচয়িতা। অগ্নিকুণ্ড তার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত গ্রন্থ।
প্রারম্ভিক জীবন
সিলেট জেলার অন্তর্গত কানাইঘাট উপজেলা-র বাটইআইল গ্রামে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ইবরাহীম আলী তশনা জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা শাহ আব্দুর রহমান কাদেরি ছিলেন একজন আলেম ও মুফতি। তিনি শাহজালালের সফরসঙ্গী শাহ তাকী উদ্দীন-এর অধস্তন বংশধর তশনার বড় ভাই মাওলানা ইসমাঈল আলম বাংলাভাষী উর্দু কবিদের অন্যতম।
শিক্ষাজীবন
ইবরাহীম আলী তশনা পিতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সেকালের জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী আজিরিয়া মাদ্রাসায় চলে যান। ফুলবাড়ী মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম শেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ফজল হক দেওবন্দি মুহাম্মদ মুনির নানুতুবি হাফেজ মুহাম্মদ আহমদ-এর তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ নয় বৎসর জ্ঞান সাধনার পর ইবরাহীম তশনা স্বগ্রামে ফিরে আসেন।
শিক্ষা আন্দোলন
দেশে ফিরে মাওলানা ইবরাহীম তশনা শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। কানাইঘাট উপজেলার উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা (১৮৯৯ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠা ছাড়াও তিনি সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদ্রাসা সহ একাধিক মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। সে সময়কালে বৃহত্তর জৈন্তা অঞ্চলে তাজবীদের উপর কুরআন শিক্ষার প্রচলন ছিল না, উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসার মধ্য দিয়ে কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠ-পদ্ধতি চালু হয়।
তশ্না উপাধি লাভ
তশনা তার ছাত্রসহ ১৯০২ সালে ২য় বার দিল্লীর পথে রওয়ানা হন। সেখানে ভারতের খ্যাতিমান আলেম নাজির আহমদ দেওবন্দির কাছে দুই বছর অধ্যয়ন করে হাদিস শাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন। এ গমনে জ্ঞান অর্জনের প্রতি অদম্য তৃষ্ণা দেখে ওস্তাদ ইবরাহীম আলীকে ‘তশ্না’ উপাধি প্রদান করেন। ফারসি ‘তশ্না’ শব্দের বাংলা প্রতিরূপ ‘তৃষ্ণার্থ’ বা ‘পিপাসার্থ’। মূলত সেসময় থেকেই ইবরাহীম আলী তশনা নামেই অধিক পরিচিত হন।
ইসলামি জলসার প্রচলন
সে সময় সিলেট অঞ্চলে ইসলামী জলসার প্রচলন ছিল না। ইতিহাসবিদদের মতে মাওলানা ইবরাহীম তশনা সর্ব প্রথম ১৩১৩ বাংলা মোতাবেক ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এক ইসলামী জলসার মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে ইসলামী জলসার প্রচলন করেন। তার প্রবর্তিত জলসায় দূরদূরান্ত হতে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হতেন। ভিন্নধর্মী এ আয়োজনের খবর অতি দ্রুত সিলেট ও আসাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন স্থানেই এ ধরনের ওয়াজ মাহফিল বা ইসলামি জলসার আয়োজন হতে থাকে। জলসা নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত সে সময়ের একটি গান,
“ ত্রিশ চল্লিশ হাজার লোক হয় এই মহফিলের মাঝে
ইসলামের ডঙ্কা বাজে- হায় হায়
রঙ্গে ঢঙ্গের ওয়াজ করে কত রঙ্গের উলামায়।”
খেলাফত আন্দোলন ও কারাবরণ
শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দির নির্দেশে ইবরাহীম আলী তশনা এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। খিলাফত আন্দোলন-এ যোগদানের জন্য তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। তশনা বাংলা ও উর্দু ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। তিনি দিল্লি জুমা মসজিদে খুতবা পাঠ করে বহুভাষীক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদ্রাসার জলসা উপলক্ষে জনসভার আয়োজন হয়। মাওলানা ইবরাহীম তশনার সভাপতিত্বে জলসার কার্যক্রম শুরু হলে ব্রিটিশ প্রশাসন এ জলসা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। সুরমা ভেলির কমিশনার জে. ই. ওয়েবস্টার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। বেলা ১২.০০ঘটিকায় সুরমা ভ্যলির কমিশনার মিষ্টার ওয়ষ্টরের আদেশে কানাইঘাট মাদ্রাসার বার্ষিক জলসায় পুলিশ বাহিনী গুলি চালায় এতে ঘটনাস্থলে ৬জন নিহত হন। নিহতরা হলেনঃ মৌলভী আব্দুস সালাম, মোঃ মুসা মিয়া, আব্দুল মজিদ, হাজী আজিজুর রহমান, ইয়াসিন মিয়া। আরো অনেক নিরীহ মানুষ আহত হন।
রচনাবলী
ইবরাহীম তশনা বাংলা ও উর্দুতে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। তিনি একাধীক উর্দু কেতাব রচনা করেন। তার রচিত কেতাবের মধ্যে তাজবিদ, শরাহ কাফিয়্যা, শরাহ উসুলুসসাশী অন্যতম। ইবরাহীম তশনা ছিলেন স্বভাব কবি। তিনি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় বহু গান ও ক্বাসিদা লিখে উত্তর ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তদানীন্তন উত্তর ভারত থেকে প্রকাশিত নানা সাময়িকীতে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশ হত। বিখ্যাত উর্দু কবি আকবর এলাহবাদী তশনার কবিতার ভক্ত ছিলেন।
১৩৪৪ বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল নূরের ঝংকার’। নুরের ঝংকার প্রকাশ করেন তশনার ছেলে সিদ্দিকুর রহমান। অগ্নিকুণ্ড একটি গীতিগ্রন্থ; নবীপ্রেমের আকুতি ঝরা গীতিমালা। তশনার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে অগ্নিকুণ্ড সংগীত গ্রন্থকেই ধরা হয়। সিলেট অঞ্চলে মানুষের মানবিক ক্রমবিকাশে মরমি সাধকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় হাসন রাজা শিতালং শাহ আরকুম শাহর পাশাপাশি ইবরাহীম তশনা এক অনিবার্য নাম।
সঙ্গীত চর্চা
খিলাফত আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ইবরাহীম তশনা রাজনৈতিক ময়দান থেকে নিষ্ক্রিয় ও আধ্যাত্মিক চর্চায় নিমগ্ন হন। এ সময়কালে তশনা প্রভুর দিদার লাভের আশায় উদাসীন জীবন যাপন করেন। ইবরাহীম তশ্না মাহবুবের দিদার লাভের আশায় উদাসীন জীবনযাপন করেন। এ সময় তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত হয় মরমি গান। এই গান তাঁর সাধনার ফসল। তাঁর গানে ধ্বনিত হয়েছে মানবহৃদয়ের গভীর ভালোবাসা ও এলাহি প্রেমের আধ্যাত্মিক বাণী।
মৃত্যু
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১৩৫০ হিজরীতে ১৩৩৮ বাংলার ভাদ্র মাসের শেষ শুক্রবারনিজ বাড়িতে ৬১ বছর বয়সে ইবরাহীম আলী তশনা মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন চার ছেলে ও এক মেয়ের জনক।
আরও দেখুনঃ