ভারতীয় উপমহাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা শুরু হয়েছে প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকেই। চার বেদের অন্যতম, সামবেদ-এ সঙ্গীতকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিষয়েরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। সামবেদে বর্ণিত স্তোত্রগুলি মূলত যজ্ঞ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সুর করে পরিবেশন করা হতো। এই প্রাচীন ধারাই কালক্রমে মন্দিরভিত্তিক সঙ্গীতচর্চার সূচনা করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সূচি
রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, এবং পালি–প্রাকৃত–সংস্কৃত সাহিত্যে সংগীতচর্চার বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। মন্দিরের গাত্রে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যগুলোতেও সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পুরাণ মতে, গন্ধর্বরা সংগীতে পারদর্শিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে ভরতমুনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র-এ সংগীতের বিভিন্ন নিয়মাবলী ও তত্ত্ব লিপিবদ্ধ করেন, যা ভারতীয় সঙ্গীততত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকে শার্ঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থে রাগ, তাল এবং তাদের প্রয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপক তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। সেই সময় পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে প্রায় অভিন্ন ধারা ও রীতিতে শাস্ত্রীয় সংগীত প্রচলিত ছিল।
হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটক সংগীতের বিভাজন
১২শ শতক থেকে আফগান ও মুঘল শাসনের সময় উত্তর ভারতের সংগীতে পারস্যীয়, আরবি ও ইসলামি সংগীতশৈলীর প্রভাব প্রবেশ করতে শুরু করে। এর ফলে ধীরে ধীরে উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীত এক ভিন্ন ধারা — হিন্দুস্থানী সংগীত — হিসেবে বিকশিত হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারত এই সাংস্কৃতিক প্রভাবে অনেকটাই নিরপেক্ষ থেকে মূল ধারার সংগীতরূপ ধরে রাখে। এই সংগীত পরিচিত হয় কর্ণাটক সংগীত নামে, যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদি ও শুদ্ধ রূপ হিসেবে বিবেচিত।
১৬শ ও ১৭শ শতকে এই দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তারা ক্রমে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন পথে এগিয়ে যায়।
উত্তর ও দক্ষিণের সাংস্কৃতিক বিভাজন ও সঙ্গীত
ভারত একটি বহুধা বৈচিত্র্যময় উপমহাদেশ। ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও ধর্মীয় আচারে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি সংগীতের ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত দুইটি প্রধান ধারায় বিভক্ত:
- হিন্দুস্থানী সংগীত – উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতে প্রচলিত।
- কর্ণাটক সংগীত – দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো যেমন কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও কেরলে ব্যাপকভাবে চর্চিত।
এইভাবে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত যুগের পর যুগ ধরে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে দিয়ে রূপান্তরিত হয়ে দুটি প্রধান ধারায় গড়ে উঠেছে — হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটক সংগীত — যাদের উভয়ের রয়েছে অসামান্য সংগীত ঐতিহ্য ও শৈল্পিক মূল্য।
হিন্দুস্থানী সঙ্গীত [ Hindustani Classical Music ]:
হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের মূল প্রেরণা এসেছে হিন্দু ধর্মে নব রস থেকে। এই সঙ্গীতের প্রচলন মূলত উত্তর ভারতে দেখা যায়।
কর্ণাটী সঙ্গীত [ Carnatic Classical Music ]:
কর্ণাটকী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা কর্ণাটকী সঙ্গীত হচ্ছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদিতম রূপ। দক্ষিণ ভারতে উদ্ভূত কর্ণাটকী সঙ্গীত হচ্ছে পৃথিবীর প্রচীনতম সঙ্গীতসমূহের একটি।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনা হয় মূলত দু’ভাবে – কন্ঠে ও বাদ্যযন্ত্রে। হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটী সঙ্গীতের কিছু কাঠমোগত বৈশিষ্ট ও রীতি রয়েছে। উভয় ধরণের সঙ্গীতেই রয়েছে দুটি মৌলিক উপাদান যা তাল ও রাগ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত।
🎼 হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে কিছু মূল পার্থক্য
১. স্বর ও স্বরের বিন্যাস
- ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গঠিত সাতটি মূল স্বর (সা, রি, গা, মা, পা, দা, নি) এবং পাঁচটি বিকৃত স্বর নিয়ে।
- কর্ণাটক সঙ্গীতে স্বরের নামের উচ্চারণে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের তুলনায় ভিন্নতা রয়েছে।
- কর্ণাটক সঙ্গীতে অতিরিক্ত চারটি বিবাদী স্বর ব্যবহৃত হয়, যা হিন্দুস্থানী বা পাশ্চাত্য সঙ্গীতে দেখা যায় না।
২. গায়কী রীতি ও অলঙ্করণ
- কর্ণাটক সঙ্গীতে স্বরগুলি আন্দোলিত বা কম্পিত করে গাওয়া হয়। গমক বা মীড় প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে স্বরগুলি স্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাবে উচ্চারিত হয়। মীড় বা স্লাইড ব্যবহৃত হয় কিন্তু অধিক মাত্রায় নয়।
৩. ভাষা ও সাহিত্যের ব্যবহারে পার্থক্য
- কর্ণাটক সঙ্গীত গাওয়া হয় প্রধানত কন্নড়, তেলুগু, তামিল ও মালায়ালম ভাষায়।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীত গাওয়া হয় হিন্দি, পাঞ্জাবি, রাজস্থানী, বৃজ ভাষায়।
- দুই ধারাতেই সংস্কৃত ব্যবহৃত হয়, বিশেষত ভক্তিমূলক গানগুলোতে।
৪. ব্যবহার্য বাদ্যযন্ত্র
কর্ণাটক সঙ্গীত | হিন্দুস্থানী সঙ্গীত |
তানপুরা, মৃদঙ্গ, কাঞ্জিরা, ঘটম, সরস্বতী বীণা, নাগস্বরম, ভায়োলিন | তানপুরা, তবলা, সেতার, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম |
- কর্ণাটক সঙ্গীতে অতিরিক্ত গমক থাকায় হারমোনিয়াম বা কীবোর্ড ব্যবহার কঠিন।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে হারমোনিয়াম অত্যন্ত জনপ্রিয় সহযোগী যন্ত্র।
৫. গানের কাঠামো ও গুরুত্বের দিক
- কর্ণাটক সঙ্গীতে সাহিত্যিক দিক (Lyrics) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গানগুলো সাধারণত তিনটি অংশে বিভক্ত হয় – পল্লবী, অনুপল্লবী, চরণাম।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে রাগের ভাব প্রকাশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গান সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত – স্থায়ী ও অন্তরা।
৬. রাগতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্বীয় ভিত্তি
- কর্ণাটক সঙ্গীত ভিত্তি করে মেলকর্তা পদ্ধতি (ভেঙ্কটমুখী প্রবর্তিত)। এতে ৭২টি মূল রাগ বা জনক রাগ আছে, যেগুলো ১২টি চক্রে বিভক্ত।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে ঠাট পদ্ধতি অনুসৃত হয়। পন্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে ১০টি ঠাটের প্রবর্তন করেন, যার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাগ সৃষ্টি হয়।
৭. তাল ও লয়চর্চা
- কর্ণাটক সঙ্গীতে ব্যবহৃত হয় ৩৫টি তাল, যার উৎস সূলাদি সপ্ততাল ও পাঁচ জাতি। গানগুলি সাধারণত একটানা নির্দিষ্ট লয়ে পরিবেশিত হয়।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে তাল মাত্রা ও বিভাগসংখ্যা অনুসারে তৈরি হয়। ধ্রুপদ বা ধামার ধাঁচে গান শুরু হয় ধীর লয়ে এবং ধীরে ধীরে গতি বাড়ে (দুগুন, তিগুন, চৌগুন ইত্যাদি)।
৮. গান বিষয়বস্তু ও রসচর্চা
- কর্ণাটক সঙ্গীতে প্রধানত ভক্তিমূলক ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে গান রচিত হয়। এমনকি শৃঙ্গার রসও পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি, সামাজিক ভাবনা ইত্যাদি নিয়েও গান রচিত হয়, যা রসচর্চায় বৈচিত্র্য আনে।
৯. মঞ্চ পরিবেশনা শৈলী
- কর্ণাটক সঙ্গীতের পরিবেশনা প্রায় ২.৫ থেকে ৩ ঘণ্টা দীর্ঘ হয়। গানের ধারা:
বর্ণম → কৃতি → রাগম-তানম-পল্লবী (RTP) → তিলানা/জাবালি। - হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের পরিবেশনা শুরু হয় আলাপ দিয়ে, এরপর ধীরে ধীরে বিলম্বিত খেয়াল/ধ্রুপদ, তারপর তান, তরানা, ঠুংরি বা গজল পরিবেশিত হয়।
১০. কল্পনাশক্তির প্রয়োগ (মনোধর্ম)
- কর্ণাটক সঙ্গীতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য মনোধর্ম সংগীত – তাৎক্ষণিক সৃজনশীলতা ও দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ:
- আলাপন
- নিরাবল
- স্বরকল্পনা
- তানম
- তানি আবর্তম
হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সংগীত উভয়ই ভারতীয় সংগীতের অনন্য ধারা। যদিও এদের মধ্যে রচনারীতি, ভাষা, বাদ্যযন্ত্র, তত্ত্ব ও পরিবেশনরীতি-তে পার্থক্য রয়েছে, তবে উভয়ের শিকড়ই এক – ভারতীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক সংগীত ঐতিহ্য।
🪔 হিন্দুস্থানী বনাম কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সংগীত: তুলনামূলক টেবিল
ক্র. | বিষয় | কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত | হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত |
১ | স্বর | ৭টি স্বর + ৪টি অতিরিক্ত বিবাদী স্বর | ৭টি স্বর + ৫টি বিকৃত স্বর |
২ | গায়কী রীতি | আন্দোলিত স্বর, গমকের ব্যাপক ব্যবহার | স্বর স্পষ্ট উচ্চারিত, মীড়ের প্রয়োগ |
৩ | ভাষা | কন্নড়, তেলুগু, তামিল, মালায়ালম | হিন্দি, পাঞ্জাবি, ব্রজ, রাজস্থানী |
৪ | বাদ্যযন্ত্র | তানপুরা, মৃদঙ্গ, কাঞ্জিরা, ভায়োলিন, সরস্বতী বীণা | তানপুরা, সেতার, তবলা, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম |
৫ | গানের গঠন | পল্লবী, অনুপল্লবী, চরণাম সহ দীর্ঘ সাহিত্য | স্থায়ী ও অন্তরা প্রধান; রাগ প্রকাশই মুখ্য |
৬ | রাগতত্ত্ব | মেলকর্তা পদ্ধতি; ৭২ জনক রাগ | ঠাট পদ্ধতি; ১০টি ঠাট |
৭ | তাল ও লয় | ৩৫টি তাল; ধ্রুব, রূপক, ঝম্প ইত্যাদি | মাত্রা ও বিভাগভিত্তিক; ধ্রুপদ, ধামার ধীর লয়ে শুরু হয় |
৮ | গানের বিষয়বস্তু | ভক্তি, আধ্যাত্মিকতা, পৌরাণিক রস | প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি, ভক্তি ইত্যাদি |
৯ | মঞ্চ উপস্থাপনা | দীর্ঘ অনুষ্ঠান; বর্ণম → কৃতি → RTP → তিলানা | আলাপ → খেয়াল/ধ্রুপদ → তান/ঠুংরি/গজল |
১০ | মনোধর্ম (কল্পনাশক্তি) | আলাপন, নিরাবল, স্বরকল্পনা, তানম, তানি আবর্তম | আলাপ, বোলআলাপ, তান, লয়কারি ইত্যাদি |
আরও দেখুন: