একদিন তোমায় চেয়ে দেখবো খোদার কাছে !
“শুনেছি খোদার কাছে চাইলে সব পাওয়া যায়।
তাই একদিন তোমাকে চেয়ে দেখতে চাই।”
কি সাধারন একটা কথা, কিন্তু কি অসাধারণ তার অনুভূতি, গভিরতা!
এটি একটি গজলের লাইন। সত্তরের দশকে লং প্লে রেকর্ডে রিলিজ হয়েছিলো। রিলিজ হতেই চারদিকে হই চই পড়ে গিয়েছিলো। এর পরে সিং [ জগজিৎ সিং – চিত্রা সিং ] দম্পত্তি যে সঙ্গীতের অনুষ্টানেই যেতেন, সেখানেই গানটি গাইতে বারবার অনুরোধ আসতো। গজল প্রেমীক শ্রোতার হৃদয়ের উদাত্ত-অনুদাত্ত-মন্দ্রস্বরে বাজিয়ে দিতো সেই চুড়ান্ত মেলানকলিক মেলডি। যে হৃদয় বলে “খাক হো যায়েঙ্গে তুমহারি খাবার হোনে তাক“।
আজ হয়তো আর এমন গজল লেখা হয় না, গাওয়া হয় না। কিন্তু এই গজলটির মধ্যে যে একবার ঢুকেছে, সে গজলটিকে আজীবনের জন্য সাথি করে নিয়েছে।
সরাসরি গানে যাওয়ার আগে, এটা যাদের সৃষ্টি, তাদেরকে একটু জানা যাক।
চিত্রা সিং নামে এক স্বপ্নের রাজকুমারী গেয়েছিলেন এই গজলটি!
তার গাওয়া এই গানটি গজল প্রিয় শ্রোতারা হয়তো কোনদিন ভুলতে পারবে না। আজও কদিন পরপর ইউটিউব লিস্টে উঠে আসে। কেউ হয়তো সেই প্রেমের প্রচণ্ড আকুতি নিয়ে গানটি শোনেন। সেখান থেকেই আবার বাকিরা সংক্রমিত হয়। সেসময়ের যুবা সবাই এক কথায় আজও স্বীকার করবেন – অদ্ভুত, অসাধারণ কিছু গান আমাদের দিয়ে গেছেন জগজিৎ-চিত্রা জুটি। জীবনের বিভিন্ন মেলান্কলিক জানালায় বারবার ফিরে আসে ওই গানগুলো।
অপূর্ব প্রেম আর সুরের জুটি ছিলেন জগজিৎ-চিত্রা সিং। দুজনে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। শুধু দুজনের প্রেমের গল্পেই শেষ না। চিত্রা সিং তার গায়কী, চেহারা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে, নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছিলেন সে সময়ের সব পুরুষের প্রেমিক হৃদয়কে। লোকে বলে – চিত্রা সিং যেবার ঢাকায় এসে অনুষ্ঠান করে গেলেন, তার পরে অন্তত ৬ মাস পর্যন্ত ঢাকার যুবকদের হৃদয় থেকে চিত্রার বিরহ সরানোই যায়নি।
হা যেই গজলটি নিয়ে কথা বলছিলাম, ফিরি সেখানে আবার।
“সুনতে হে, কে মিল যাতেহে, হার চিজ দুয়া সে” শিরনামের সেই গজলটি। যতদূর জানা যায় এই গজল লিখেছিলেন রানা আকবারবাদী [সোহাইল রানা]। কিন্তু সবগুলো মিসরা বা কাপলেট গজলে গাওয়া হয়নি।
এই গজলটিতে সুর দিয়েছিলেন জগজিৎ সিং। স্বামীর সুর, স্ত্রীর কণ্ঠ। গজলটি হৃদয়কে এতটা কাতর করার, অন্যতম প্রধান কারণ, গজলটি কম্পোজ করা হয়েছে “দরবারী” রাগে, যে রাগটিকে “সম্রাটের কান্নার” ব্যক্ত করার উপযুক্ত ভাষাও বলেছেন অনেক গুণীজন। অত্যন্ত মেলান্কলিক এই রাগটি খুব ভালোভাবে ব্যবহার করেছিলেন জগজিৎ।
এই গজলের সাদামাঠা উর্দু অনুবাদ এভাবে দাড়ায়:
Sunte hain ke mil jaati hai har cheez dua se
“সুনতে হ্যায়, কি মিল যাতি হ্যায়, হার চিজ দুয়া সে,
[ শুনেছি, সব কিছু মিলে যায়, খোদার কাছে দোয়ায় চাইলে]
ik roz tumhain maang ke dekhainge khuda se…….
ইক রোজ, তুমেহ মাংকে, দেখেঙ্গে খুদা সে।
[ তাই একদিন, খোদার কাছে, তোমায় চেয়ে দেখবো [ দেখি পাই কি না] ]
jab kuch na mila haath duaon ko utha kar
যাব কুছ না মিলা থা তো, দোয়া কো উঠা কার।।
[দীর্ঘ প্রার্থনা করার পর, যখন খালি হাতে ফিরলাম ]
phir haath uthane hi pare humko dua se………….
ফের হাত উঠানে হি পাড়ে, হামকো দোয়া ছে।।
[ তখন প্রার্থনাই ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমার আর কি উপায় ছিলো]
দুনিয়া ভি মিলি হ্যায়, গামে দুনিয়া ভি মিলা হ্যায়,
duniya bhi mili hai gham-e-duniya bhi mila hai
[ দুনিয়ার সবকিছু পেয়েছি, সেই সাথে বিষাদের দুনিয়াও পেয়েছি]
wo kyun nahi milta jise manga tha khuda se…….
ওও কিউ নেহি মিলতা জিসে মাংগা থা খুদা সে।
[ কেন তাকেই পেলাম না, যাকে আসলে চেয়েছিলাম খোদার কাছে !]
ae dil tu unhain dekh ke, kuch aise tarapna
এয় দিল তু উনহিকো দেখ কে, কুছ এয়সে তাড়াপনা,
[ ও মোর হৃদয়, তাকে দেখে তুই এমনভাবে উত্তেজিত হবি]
aa jae hansi unko jo baithe hain khafa se………
আ যায়ে হাসি উনকো, যো ব্যায়ঠেতে খাফা সে
[ যেন সে রেগে থাকলেও, আমার অবস্থা দেখে দেখে হেসে ফেলে ]
tum samne baithe ho to hai kaif ki barish
তুম সামনে ব্যায়ঠে হো, তো ক্যায়েফ কি বারিশে,
[ তুমি সামনে থাকা মানে, আনন্দের বর্ষণ]
wo din bhi the jab aag barasti thi ghata se
উয়ো দিন ভি থে, যব আগ বারাসতি থি ঘাটা সে
[ সেও এক সময় ছিল, যখন মেঘ থেকে অগ্নিবৃষ্টি হতো ]
গজলের প্রথম “মিসরা” বা কাপলেট কোন প্রেমিক/প্রেমিকা তার প্রেমিক/প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে বলছে “একদিন তোমায় চেয়ে দেখবো খোদার কাছে“। চাওয়ার আকুলতা দেখেই বোঝা যায়, বিরহই সম্ভবত সবচেয়ে কাছের নিয়তি।
এর পরের মিসরাটি যেই ভাবনার উদ্রেক করে তা হলো – একটি অতৃপ্ত হৃদয় আল্লাহর দরবারে অভিযোগ নিয়ে বসে আছে। বলছে “যে লোকে বলে তোমার কাছে চাইলেই সব পাওয়া যায়। কিন্ত আমি তো তাকে চাইলাম, পেলাম না! “। আর সেখানেই অভিমানের প্রকাশ। সে বলছে তার দোয়ার নিষ্ফলতা তাকে প্রার্থনা ছেড়ে দেবার দিকে ধাবিত করেছে। শেষে আবার বলছে – “আমাকে সারা দুনিয়া দিলে, কিন্তু শুধু একজনকে দিলে না বলে এই দুনিয়াটি আমার দুখের দুনিয়াতে পরিণত হলো“।
এই গজলে আর একটি বিশেষ বিষয় আছে, জগজিৎ সিং মূলত কম্পোজ করতেন ১ থেকে দেড় সপ্তকের [অক্টেভের] মধ্যে [ লোকে বলে তিনি সেটা করতেন কারন তিনি জেনে গিয়েছিলেন তার শ্রেষ্ট অংশটুকু কোনটুকু]। কিন্তু এই গানটির ক্ষেত্রে তিনি সেই বাধাতে থেমে থাকেন নি। সুরকে বইতে দিয়েছেন অশান্ত হৃদয়ের প্রবাহের মতো।
এই গজলটা প্রথম মিসরা বা মাতলা থেকেই একটু অন্য রকম। গজলের “রাদিফ” টিপিক্যালি ব্যবহার হলেও “কাফিয়ার” ব্যবহারে একটু আলাদা।
আরও পড়ুন:
- সঙ্গীত গুরুকুল : গজল