Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন [ ১৯০১-১৯৭৩ ] Ostad Munshi Raisuddin

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন – বাংলাভূমির এক বিদগ্ধ সংগীতগুণীজন। ব্রিটিশ শাসনামলে যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) নাকোল গ্রামে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি মতে ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৩ পৌষ শুক্রবার এক ধার্মিক মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুন্সি আব্বাসউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ।

সংগীতের প্রতি কোনো রকম অনুরাগ ছিল না তাঁর কোনো দিনও। কিন্তু ধর্মের প্রতি ছিল অসীম ভক্তি। পারিবারিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বড় হলেও বাল্যকালেই সুর ও সংগীতের মোহনীয় আকর্ষণে আকৃষ্ট হন রইসউদ্দীন। শৈশব থেকেই ছিলেন তিনি সুকণ্ঠের অধিকারী এবং সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ।

বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সব অনুষ্ঠানে মিষ্টি ও সুরেলা কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করে তিনি ভূয়সী প্রশংসা ও প্রচুর পুরস্কার লাভ করেন। অসামান্য প্রতিভাবান রইসউদ্দীন ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল, অধ্যবসায়ী, মেধাবী ও পরিশ্রমী। ছোটবেলা থেকেই নিজ গ্রাম এবং আশপাশের সব সংগীত জলসায় গান শুনতে যাওয়া ছিল তাঁর একটি অবধারিত কাজ।

সুরের প্রতি প্রবল আকর্ষণ আর দৃঢ়প্রত্যয় এই দুয়ের সমন্বয়েই নিজেকে একজন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন এর সন্তানের স্মৃতিচারণ:

ফুপাত বড় ভাই সংগীতশিল্পী শামসুল হকের কাছেই উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন তিনি। সংগীতের উচ্চমার্গীয় শিক্ষালাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে লালন করে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি মাগুরার নাকোল গ্রাম ছেড়ে কাউকে কিছু না বলে একাকী কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি জমান।

অবশ্য এ বছরই তিন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতায় অপরিচিত মহলে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবহীন অবস্থায় গিয়ে দারুণ বিপাকে পড়ে যান রইসউদ্দীন। বেঁচে থাকার তাগিদে দিনে চাকরির সন্ধান করতেন এবং রাতে ফুটপাত কিংবা শিয়ালদহ স্টেশনে ঘুমাতেন। অবশেষে ভাগ্য তাঁর সুপ্রসন্ন হলো একদিন।

পরিচিত হলেন প্রসিদ্ধ সংগীতজ্ঞ নুলো গোপালের (গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী) শিষ্য পণ্ডিত রাসবিহারী মল্লিকের সঙ্গে। নিবেদিতপ্রাণ শিষ্য পেয়ে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম প্রদানে কার্পণ্য করলেন না পণ্ডিতজি। কয়েক বছর একাগ্রচিত্রে গুরুজি রাসবিহারী মল্লিকের কাছে ধ্রুপদ ও খেয়াল শিখলেন রইসউদ্দীন।

এরপর লক্ষ্ণৌর সংগীতবিশারদ পণ্ডিত শরজিৎ কাঞ্জিলালের কাছে কণ্ঠসংগীতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন তালিম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীতসাধক ও সংগীতবিশারদ পণ্ডিত গিরিজাশংকর চক্রবর্তীর ‘সংগীত কলা ভবনে’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি কঠোর সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন।

এর মধ্যেই সংগীতসমাজে শিল্পী মুনশী রইসউদ্দীনের নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আকাশবাণী কলকাতার সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন তিনি। শুদ্ধ সংগীত প্রচার ও প্রসারে ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দীনের অবদান অসামান্য। সংগীতশিক্ষা প্রসারের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকার জন্য বিভিন্ন স্থানে তিনি সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি প্রবেশিকা সংগীত বিদ্যালয়’ নামে একটি শুদ্ধ সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সংগীতশিক্ষা দ্রুত প্রসার লাভ করুক এই প্রত্যাশায় তিনি মাগুরা, নড়াইল ও খুলনাতেও একাধিক সংগীত বিদ্যালয়’ স্থাপন করেন।

সংগীত সাধনায় একাগ্রচিত্ত ওস্তাদ মুন্শী রইসউদ্দীন ছিলেন শিল্পীসুলভ গুণে অনন্য প্রতিভার অধিকারী। সাধনালব্ধ জ্ঞান বিতরণে তিনি ছিলেন উদারপ্রাণ একজন সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। রাগসংগীতের কঠিন কঠিন বিষয়কে সহজবোধ্য করে সাধারণের মাঝে প্রচার ও প্রসারে তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ সেবক।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন এর শিক্ষার্থীবৃন্দ :

ওস্তাদ মুন্শী রইসউদ্দীনের অসংখ্য গুণগ্রাহী সংগীত শিক্ষার্থীর মধ্যে গোপাল চন্দ্র দাস, ওমর ফারুক, নিতাই রায়, আমানুল্লাহ খান, শেখ লুৎফর রহমান, ওস্তাদ বেদারউদ্দীন আহমদ, বদরুল আলম, সৈয়দ শামসুল হুদা, সাধন সরকার, মোশারফ হোসেন, নাজিম মাহমুদ, মো. হাফিজুর রহমান, এ কে এম শামসুল হুদা, সুশান্ত কুমার রায় (বেণী বাবু), আদিনাথ গোপ, প্রভাত চন্দ্র ধর, সুরাইয়া খলিল, নিত্য গোপাল সাহা।

তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও ছিলেন – অঞ্জলী দত্ত, মো. শামছুদ্দোহা, খাজা গোলাম মঈনউদ্দীন, জাহানারা ইসলাম, সেলিনা বাহার জামান, শৈলেশ চন্দ্ৰ ভৌমিক, আনোয়ারুল ইসলাম, খান আমানুর রহমান, মামুনুর রশীদ, রাম গোপাল মোহন্ত, আলেয়া শরাফী, দিলশাদ খানম, মো. রেজা মজিদ, আবুদর রউফ, মো. মশিউল আলম, কেশব লাল কাশারী, হাজেরা খান পন্নী।

তার শিক্ষার্থী ছিলেন – লতিফা হিলালী, মো. আরিফুর রহমান, ফেরদৌসী ইসলাম, মাহমুদা খাতুন, জাহানারা বেগম, গীতা দত্ত, সারোয়ার হোসেন, মনোয়ার হোসেন খান, তিমির নন্দী, আবদুস সাত্তার, সতীন্দ্রনাথ হালদার, পরিতোষ ব্যানার্জি, আবদুর রহমান, আশফাকুর রহমান খান, খন্দকার ফারুক আহমেদ, আব্দুল মুত্তালিব বিশ্বাস।

তার কাছে শিখেছিলেন – অমল বোস, মাহমুদা চৌধুরী তুলি, ড. সন্জীদা খাতুন, ফেরদৌসী রহমান, আবু বকর খান, মালেকা আজিম খান, লতিফা চৌধুরী, নাসরিন শামস্, সাবিহা মাহবুব, তাজিন চৌধুরী, মিলিয়া আলী, রশিদা চৌধুরী, খুরশিদ আজিম সিদ্দিকী, শওকত আরা ইসলাম এবং ভারত পশ্চিমবঙ্গের ইলা বসু ও শ্রিপা দাস প্রমুখ নাম উল্লেখযোগ্য।

তিনি ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমি’র সহ-অধ্যক্ষ এবং ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ঢাকা বেতারের নিয়মিত উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী হিসেবে বহু খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা, ধ্রুপদ ইত্যাদি পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে দিতেন তিনি।

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন এর সঙ্গীত বিষয়ক রচনা :

সংগীতবিষয়ক গ্রন্থ রচনায় এদেশের ওস্তাদ ও বিজ্ঞজনদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর রচিত সরল সংগীত সার-সংগ্রহ, ছোটদের সা-রে-গা-মা, অভিনব শতরাগ, সংগীত পরিচয়, রাগলহরী, গীতলহরী উল্লেখযোগ্য সংগীতবিষয়ক গ্রন্থ । গবেষণামূলক সংগীতগ্রন্থ অভিনব শতরাগ রচনার জন্য তিনি ‘আদমজী পুরস্কার’ লাভ করেন।

শিল্পগুরু জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রবর্তিত আকার মাত্রিক স্বরলিপি পদ্ধতির সঙ্গে মিল রেখেই তিনি একটি স্বরলিপি পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন। লেখা, বোঝা ও ছাপাখানায় কম্পোজিংয়ের সুবিধার কথা ভেবে সহজরূপে রচিত এই স্বরলিপি পদ্ধতির নাম দেন ‘সহজ স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি’।

বাংলাদেশে তিনি নিজ প্রবর্তিত সহজ স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি প্রচলনের যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও তাঁর মৃত্যুর পর অজ্ঞাত কারণে এর প্রচার ও প্রসার ঘটেনি। সংগীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ সম্মানে ভূষিত করেন।

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন এর পরিবার :

এ এফ এম আলিমউজ্জামান, শাহীনা সুলতানা বেবী, এ এফ এম আসাদুজ্জামান এবং এ এফ এম আশিকুজ্জামান টুলু এই তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দীন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, সদা সত্যবাদী ও সাদাসিধে প্রকৃতির মানুষ।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল অনুযায়ী ১৩৮০ বঙ্গাব্দের ২৮ চৈত্র তারিখে অসংখ্য শিক্ষার্থী, গুণগ্রাহী ও ভক্তদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে এই বরেণ্য সংগীতজ্ঞ পরলোকের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সংগীতের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই মহান সাধক সংগীতজ্ঞকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়।

ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন [ ১৯০১-১৯৭৩ ]

আরও পড়ুন :

Exit mobile version