বিদগ্ধ সুরসাধক ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ এক বিখ্যাত সংগীত পরিবারের উত্তরসূরি। তিনি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে গোয়ালিয়রে জন্মগ্রহণ করেন। প্রপিতামহ ওস্তাদ গুলাম বন্দেগি ছিলেন তৎকালীন সময়ের সুবিখ্যাত রবাবশিল্পী। তাঁর পুত্র ওস্তাদ গুলাম আলী পিতার কাছে রবাববাদন শিখে সেই বাদ্যযন্ত্রের অনুসরণে সরোদ বাদ্যযন্ত্রের জনক হিসেবে বরণীয় হন।
ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ [ Ustad Hafiz Ali Khan ]
ওস্তাদ গুলাম আলীর সুযোগ্য পুত্র নন্নে খাঁ একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সরোদবাদক হিসেবে গোয়ালিয়র রাজসভায় সভাবাদক পদে নিজের স্থান করে নেন। পিতার উপযুক্ত পুত্র হাফিজ আলী খাঁ সাধনার মাধ্যমে এক বিশেষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন এবং ‘আফতাবে-সরোদ উপাধি লাভ করে রাজসভায় পিতার আসনে সমমর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হন। পিতা ওস্তাদ নন্নে খাঁ উচ্চাঙ্গসংগীতের গুরুত্ব বুঝতেন বলেই হয়তো পুত্র হাফিজকে উপযুক্ত তালিম প্রদান করেছিলেন।
সংগীতশিক্ষার উদগ্র বাসনায় তাড়িত হয়ে পরে তিনি বৃন্দাবনে প্রখ্যাত ধ্রুপদিয়া ও হোলি গায়ক মহারাজ গণেশলাল চৌবে, রামপুরের বিশ্ববিশ্রুত সভাবাদক ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে হোলি, ধ্রুবগান ও সুরশৃঙ্গার বাদ্যযন্ত্রের তালিম গ্রহণ করেন।
বৈবাহিক সূত্রে তিনি রামপুরের নবাব হামিদ আলীর পরম আত্মীয় ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। ফলে নবাবগুরু ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ সাহেবের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয় তাঁর। বিখ্যাত সেতারবাদক ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের বাদনশৈলী তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। তিনি ওস্তাদ আমির খাঁর বাদনরীতি এবং নিজস্ব ঢঙের সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন।
“তাঁর দ্রুত তান ক্ষেপণে রাগের শুদ্ধতা রক্ষা করা অনিবার্য বলে মনে হতো। কেননা, অনেক সময় বিশেষ করে তান-এর ক্ষেত্রে সমপ্রকৃতির রাগের মিশ্রণ অনেক শিল্পীর কণ্ঠে বা বাদনে অনুসৃত হতে দেখা যায় বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। কারণ, সুহা কানাড়া, সুঘরাই কানাড়া, দরবারী কানাড়া ইত্যাদি তানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা হয় না’।
ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁর বাদনে মুগ্ধ হয়ে গোয়ালিয়রের রাজা তাঁকে রাজদরবারের সভাসংগীতজ্ঞ পদে সসম্মানে নিযুক্ত করেছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তাঁর অনন্যসাধারণ রাগ রূপায়ণক্ষমতা তৎকালীন সংগীতাঙ্গনে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
সমগ্র ভারতে তাঁর সুরের ঢেউ অপূর্ব ভালোলাগার দোলা দিয়েছিল। তিনি কলকাতা, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে ১৯২০-২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংগীত সফর করে বেড়ান। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরের তিন বছর তিনি গুরুজি ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ, গুরুবন্ধু নবাব চম্মন খাঁ এবং রামপুরের নবাব হামিদ আলী খাঁকে হারান। এর কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী ও শ্বশুর সাহেব ইন্তেকাল করেন। প্রিয়জনদের বিয়োগব্যথায় অত্যন্ত মুষড়ে পড়েন তিনি। তারপর থেকে বেশিরভাগ সময় তিনি গোয়ালিয়রেই কাটাতেন।
বেশ কিছুদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ থেকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর অসাধারণ সংগীত প্রতিভা ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। শিল্পীজীবনে দর্শক-শ্রোতার কাছ থেকে যেমন অঢেল শ্রদ্ধা লাভ করেছেন তিনি তেমনি স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন খেতাব ও বহু সম্মাননা। ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’, বিশ্বভারতী ‘দেশীকোত্তম’ এবং খয়রাগড় বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডিলিট’ প্রদান করে সম্মানিত করে। খ্যাতিমান পিতার সুযোগ্য পুত্র মুবারক, বাব্বু ও আমজাদ আলী খাঁ উত্তর সাধক হিসেবে পরিচিতি লাভসহ স্বপ্রতিভায় হয়েছে উদ্ভাসিত।
আরও দেখুন: