Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

কর্নাটকী সঙ্গীত | শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কর্নাটকী সঙ্গীত | শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

কর্নাটকী সঙ্গীত (Carnatic Music) বা কর্ণাটকীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাচীনতম এবং গূঢ়তর একটি রূপ, যার উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতে। এটি পৃথিবীর প্রাচীন সংগীত ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। কর্নাটকী সঙ্গীতেও রাগ ও তালের ব্যবহার রয়েছে, তবে সেগুলো এক বিশেষ ধরণে ও কাঠামোয় গঠিত। এখানে ৭২টি মেলোডিক স্কেল বিদ্যমান, যেগুলোকে মেলাকারতা রাগ বলা হয় এবং সঙ্গতের জন্য আছে ১০৮টি বিভিন্ন ধরণের তাল

 

কর্নাটকী সঙ্গীত | শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

 

পূরণধারা দাস: কর্নাটকী সঙ্গীতের পিতা

এই ধারার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পূরণধারা দাস (১৪৮০–১৫৬৪) সর্বাধিক পরিচিত। তিনি একজন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী এবং ভক্তি আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ। তিনি প্রায় ৪,৭৫,০০০ গান রচনা করেছিলেন, যদিও এর অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। পূরণধারা দাসই পরবর্তী যুগের সঙ্গীতসাধকদের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন।

 

উৎপত্তি, প্রসার বৈশিষ্ট্য

কর্ণাটকী সঙ্গীত মূলত দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা রাজ্যসমূহ এবং শ্রীলঙ্কায় প্রচলিত। এটি সামবেদ-নির্ভর হিন্দু আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিকাশ লাভ করেছে। অপরদিকে, উত্তর ভারতের হিন্দুস্তানি সঙ্গীত পারসিক ও ইসলামিক প্রভাবের অধীনে বিকশিত হয়।

এই ধারায় প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয় কণ্ঠ সঙ্গীতের উপর। অধিকাংশ রচনাই গাওয়ার জন্য রচিত এবং যন্ত্রে পরিবেশনের ক্ষেত্রেও গায়কি (ভোকাল) ঘরানাকে অনুসরণ করা হয়।

 

গঠন, শৈলী শিক্ষা পদ্ধতি

যদিও হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকী সঙ্গীতের মধ্যে কিছু শৈলীগত পার্থক্য রয়েছে, তথাপি শ্রুতি, স্বর, রাগতাল—এই চারটি মৌলিক উপাদান উভয় ধারাতেই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা কর্নাটকী সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যদিও এটি সাধারণত সংযুক্ত রচনার মাধ্যমে পরিবেশিত হয়।

প্রধান রচনাশৈলী কৃতি (বা কীর্তনম), যা ১৪শ থেকে ২০শ শতকের মধ্যে ত্যাগরাজ, মুথুস্বামী দীক্ষিত এবং শ্যামা শাস্ত্রীর হাতে বিকশিত হয়। কর্নাটকী সঙ্গীত শেখানো ও শেখার পদ্ধতিও মূলত গুরু-শিষ্য পরম্পরাভিত্তিক এবং মৌখিক শিক্ষায় গঠিত।

 

ভাষা সঙ্গীত রচনার ভূমিকা

এই ধারায় তেলুগু সংস্কৃত ভাষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অধিকাংশ রচনাই এই দুটি ভাষায় রচিত। কিছু কিছু রচনা তামিল ভাষাতেও পাওয়া যায়।

 

পরিবেশনা বাদ্যযন্ত্র

কর্ণাটকী সঙ্গীতের পরিবেশনায় সাধারণত একাধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। একজন প্রধান শিল্পী (সাধারণত কণ্ঠশিল্পী), একজন সুরসঙ্গী (বেহালা), একজন তালসঙ্গী (মৃদঙ্গম), এবং একটি তানপুরা থাকে, যা পরিবেশনায় সুরের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে। অন্যান্য যন্ত্রগুলির মধ্যে ঘটম, কাঞ্জিরা, মোরসিং, বেণু বাঁশি, বীণা গোট্টুবাদ্যম অন্যতম।

 

আধুনিক প্রেক্ষাপট উৎসব

আজকের দিনে চেন্নাই কর্ণাটকী সঙ্গীতের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে এবং সারা বিশ্বে বিভিন্ন সঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষভাবে মাদ্রাজ মিউজিক সিজন হলো বিশ্বের বৃহত্তম সংগীত উৎসবগুলোর একটি, যা এই ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার প্রতীক।

 

এইভাবেই কর্ণাটকী সঙ্গীত, তার ইতিহাস, ধারাবাহিকতা, আধ্যাত্মিক গভীরতা এবং শৈল্পিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে ভারতীয় সঙ্গীতের একটি গৌরবময় অধ্যায় তৈরি করেছে।

 

কর্ণাটী সঙ্গীতের উৎপত্তি, উৎস এবং ইতিহাস

ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য শিল্পরূপের মতো, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকেও একটি ঐশ্বরিক শিল্পরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দেবদেবীদের কাছ থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয় এবং ‘নাদ ব্রাহ্ম’ হিসেবে পূজিত হয়। প্রাচীন শাস্ত্রে প্রাণী ও পাখির স্বরধ্বনির অনুকরণে সঙ্গীত সৃষ্টির কথা উল্লেখ আছে, যা মানুষের গভীর পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির ফসল।

সামবেদকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এতে ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলো সুরবদ্ধভাবে গাওয়া হত। যজুর্বেদে বীণার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা কণ্ঠ্য আবৃত্তির সঙ্গী ছিল। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও সঙ্গীতের উল্লেখ রয়েছে।

যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে উল্লেখ আছে—
वीणावादन तत्त्वज्ञः श्रुतीजातिविशारदः ताळज्ञश्चाप्रयासेन मोक्षमार्गं नियच्छति”—
যার অর্থ: “যিনি বীণা, শ্রুতি ও তাল বোঝেন, তিনিই মোক্ষ লাভ করেন।”

ভরতের নাট্যশাস্ত্রইলাঙ্গো আদিগালের সিলাপ্পাদিকারম-এ সঙ্গীতের মূল উপাদান (স্বর, রাগ, তাল)-এর বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে, যা কর্নাটকী সঙ্গীতের ভিত্তি স্থাপন করে।

১২ শতকের পর উত্তর ভারতে পারসিক ও ইসলামি প্রভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দুটি শাখায় বিভক্ত হয়— হিন্দুস্তানিকর্নাটকী সঙ্গীত। শারঙ্গদেবের সঙ্গীত রত্নাকর-এ বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক বিশদ আলোচনা আছে।

১৬–১৭ শতকে কর্নাটকী সঙ্গীত তুলনামূলকভাবে ফার্সি-আরবি প্রভাবমুক্ত থেকে নিজস্ব ধারায় বিকশিত হয়, বিশেষ করে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায়।

পুরন্দর দাস কর্নাটকী সঙ্গীত শিক্ষার ভিত্তি পদ্ধতি তৈরি করেন এবং তাকে “কর্নাটক সঙ্গীতের পিতামহ” বলা হয়। ভেঙ্কটমাখিন তাঁর চতুর্দণ্ডী প্রকাশিকা গ্রন্থে রাগ শ্রেণিবিন্যাসের মেলকর্তা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীতে গোবিন্দাচার্য আরও প্রসারিত করেন।

১৮–১৯ শতকে কর্নাটকী সঙ্গীত মহীশূর, ত্রিবাঙ্কুর এবং তাঞ্জোরের মারাঠা শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। বহু রাজপরিবারের সদস্যরাও ছিলেন গুণী শিল্পী— বীণা, রুদ্রবীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ ইত্যাদি বাজানোয় পারদর্শী। প্রখ্যাত দরবারি সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে বীণে শেষান্নাবীণে সুবান্না উল্লেখযোগ্য।

১৯ শতকের শেষে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) কর্নাটকী সঙ্গীতের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর শিল্পটির পৃষ্ঠপোষকতা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তৃত হয় এবং সভা-র মতো প্রতিষ্ঠান টিকিটের মাধ্যমে পরিবেশনার আয়োজন শুরু করে।

কর্নাটকী সঙ্গীতের গানের ধরনসমূহ

১. বর্ণম:
এই গান শিক্ষার ও পরিবেশনার উভয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুটি অংশ:

বর্ণম দুই রকমের:

২. কৃতি:
ভক্তিমূলক গান যা পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত। তিন ভাগে বিভক্ত:
পল্লবী, অনুপল্লবী ও চরণম। চরণমের শেষে গীতিকারের নাম বা ‘মুদ্রা’ থাকে। এই ধরণের গানে কর্নাটকী ত্রয়ী (Tyagaraja, Muthuswami Dikshitar, Syama Sastri) জনপ্রিয়তা আনেন।

৩. পদম:
গম্ভীর, ধীর গতির ও ভক্তিমূলক গান। ‘মধুর ভক্তি’ ভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত নৃত্যের সঙ্গে পরিবেশিত হয়।

৪. জাবালি:
‘জাবাড়ি’ শব্দ থেকে আগত। উনিশ শতকে জনপ্রিয় হয়। হালকা প্রকৃতির গান যা দ্রুত গতিতে পরিবেশিত হয়, বিশেষত নৃত্য পরিবেশনার সময়।

৫. তরঙ্গম:
ভগবান কৃষ্ণের প্রশংসায় গাওয়া হয়। এই গান সবসময় নির্দিষ্ট কাঠামো মেনে চলে না। ভজন বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।

৬. তিলানা:
১৮ শতকে উদ্ভব। হিন্দুস্তানি তারানা গানের অনুরূপ।
মিলাট্টুর বীরবদ্রেইন এর প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। এতে কিছু অর্থবোধক অংশ থাকে, বাকিটা হয় তাল ও নৃত্যের বোল সম্বলিত।

আরও দেখুন:

Exit mobile version