কাওসার আহমেদ চৌধুরী । বাঙালি লেখক, গীতিকার, কার্টুনিস্ট, চিত্রশিল্পী ও চিত্রনাট্যকার

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ছিলেন একজন বাংলাদেশি জনপ্রিয় গীতিকার ও জ্যোতিষী। তিনি শিল্পের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন যার ফলশ্রুতিতে গীতিকবি ও জ্যোতিষী ছাড়াও তার আরও কিছু পরিচিতি রয়েছে একাধারে কবি; কার্টুনিস্ট; চিত্রশিল্পী; চিত্রনাট্যকার ; বেতার নাটক লেখক ও পরিচালক; ছোটগল্প ও রম্যলেখক এবং প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। তিনি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় আপনার রাশি নামে রাশিফল গণনার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যান্ড ও সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য বেশ কিছু আধুনিক বাংলা গান রচনা করেছেন, তাদের মধ্যে ফিডব্যাক, লাভ রান্‌স ব্লাইন্ড, মাইলস, মাহমুদুন্নবী, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, প্রবাল চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী, লাকী আখান্দ, সুবীর নন্দী, হ্যাপী আখান্দ এবং নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী অন্যতম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা জনপ্রিয় গানসমূহের মধ্যে রয়েছে এই রুপালি গিটার ফেলে (এলআরবি), আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না (সামিনা চৌধুরী, লাকী আখান্দ), যেখানে সীমান্ত তোমার (কুমার বিশ্বজিৎ), কবিতা পড়ার প্রহর (সামিনা চৌধুরী), আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে (নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী), মৌসুমি কারে ভালোবাসো তুমি ১ (ফিডব্যাক), কত যে খুঁজেছি তোমায় (নিলয় দাশ), সখি চলনা (সৈয়দ আব্দুল হাদী, ঘুড্ডি) প্রভৃতি।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী । বাঙালি লেখক, গীতিকবি, কার্টুনিস্ট, চিত্রশিল্পী ও চিত্রনাট্যকার

প্রারম্ভিক জীবন

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ-এ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। কিন্তু শেষবর্ষে তিনি চারুকলার পাঠ অসমাপ্ত রেখে পুনরায় সিলেট এম সি কলেজ-এ ভর্তি হয়ে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বি সি সি ইউনিট “স্ক্রিপ্টরাইটার” পদে সরকারি চাকরিরত ছিলেন ২০০০ সাল পর্যন্ত।

জীবন-তথ্যপত্র

স্কুল জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুকুল ফৌজ স্কাউটিং ড্রাইভের ট্রেনিং ছবি আঁকা ধ্যান জ্যোতিষচর্চা, ক্রিকেট এবং গল্প-কবিতা-নাটক লেখা ও লাইব্রেরীতে নিয়মিত পাঠচর্চা।তিনি ১১ বছর বয়সে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা শুরু করেন।

চারুকলা ইন্সিটিউটে ভর্তি হবার পর থেকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি চলচিত্র নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু এবং চলচিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসি-তে নিয়মিত যাতায়াত শুরু। এই সময়ই বাংলা ও ইংরেজি কবিতার সিরিয়াস পাঠকে পরিণত এবং কবিতা লেখার প্রথাগত অনুশীলন শুরু। অবশ্য এসব কবিতা মুদ্রিত হয়েছে খুবই কম। ক্লাব ক্রিকেটে যোগদান ফার্ম বয়েজ ক্রিকেট ক্লাব, তেজগাঁও।

এরপর সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত। ছাত্র সংসদের সংস্কৃতি সম্পাদক নির্বাচিত। এ সময়ে কলেজের এবং সিলেট শহরের সাংস্কৃতিক তৎপরতায় এক অভূতপূর্ব জোয়ার সৃষ্টি। পাশাপাশি কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচনা, গীতিনাট্যের ধারাভাষ্য রচনা, আবৃত্তি ও ধারাভাষ্য পাঠ, মঞ্চসজ্জা, সংকলনাদির প্রচ্ছদ অংকন, সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা ইত্যাদি।

সিলেট এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের উদ্বোধনলগ্নে কলেজের ছাত্র সংসদের প্রথম ভিপি নির্বাচিত।

১৯৬৮ তে ঢাকায় এসে সুইডিশ কমিউনিকেশন প্রোজেক্টের স্ক্রিপ্টরাইটার পদে যোগদান। কর্মস্থলে উন্নয়নমূলক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনার ওপর প্রশিক্ষণ।

তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের নিয়মিত গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত। প্রথম স্টুডিও রেকর্ডঃ ‘অনুষ্ঠানের প্রথম গানখানি’, শিল্পী মাহমুদুন্নবী, সুরকার সুজেয় শ্যাম।

১৯৬৯ এ এইচএমভি থেকে শেখ সাদীর সুরে মৌসুমী কবিরের কন্ঠে প্রথম ডিস্ক রেকর্ড বের হয়।

নবগঠিত “আমরা ক’জনা” সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগদান। নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা ও অরুণাভ সরকার প্রমুখের পাশাপাশি পূর্ণ উদ্যমে কবিতা লেখা হয়।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী । বাঙালি লেখক, গীতিকবি, কার্টুনিস্ট, চিত্রশিল্পী ও চিত্রনাট্যকার

১৯৭০ এ নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রেমাংশুর রক্ত চাই” এর প্রচ্ছদ। এদেশে কবির ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ তখন ছিল সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৭১ এ সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেক্টর ২, প্রশিক্ষণঃ আগরতলা, ভারত।

স্বাধীনতার পর যশস্বী ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ঢাকা আগমনের প্রথম দিন থেকে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপিত এবং তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও শিষ্যে পরিণত।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৭২ বা ১৯৭৩ এ বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস কর্তৃক “বিশ শতকের যন্ত্রণা ভরা গান” শীর্ষক গানের কথা বছরের সেরা গীতিকবিতা হিসেবে মনোনীত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে নিয়মিত গান প্রচারিত হতে থাকে।

চাকরিসূত্রে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ভিডিও চিত্রনাট্য রচনা ও চিত্র নির্মাণের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ।

চাকরিসূত্রে ঢাকায় দেশী ও আন্তর্জাতিক কমিউনিকেশনস মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত অসংখ্য ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ। খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ কাউন্সিল লন্ডনের পিটার কিং, ওয়ার্ল্ড ভিউ ইন্টারন্যাশনালের জন রিভার, অ্যামেরিকার তথ্যচিত্র নির্মাতা ও অভিনেত্রী এসটা ডি ফসার্ড, অভিনেতা জ্যাক বুন প্রমুখ।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী । বাঙালি লেখক, গীতিকবি, কার্টুনিস্ট, চিত্রশিল্পী ও চিত্রনাট্যকার

উল্লেখ্য, এসময়ে সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র একমাত্র শক্তিশালী শিল্প ও উত্তাপন মাধ্যম এবং কবিতা একটি মৃত মাধ্যম – এই অসূয়ক বা সিনিক্যাল সিদ্ধান্ত থেকে কাব্যচর্চায় পূর্ণচ্ছেদ পড়ে। চিত্রবিদ্যার চর্চাও সীমিত হয়ে পড়ে মূলত শুধু কার্টুন ও প্রচ্ছদ অঙ্কনের মধ্যে। ছোটদের ও তরুণদের সংকলন এবং ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিশেষ বিশেষ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত সংকলন সমূহে কিছু কিছু বার্তা ভিত্তিক কবিতা ও ছড়া লেখা অবশ্য অব্যাহত থাকে।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৭৪ এ প্রথম চলচ্চিত্রের গান রচনা আজমল হুদা মিঠু প্রযোজিত বাংলাদেশের প্রথম রঙিন চলচিত্র ‘বাদশা’-তে। গানঃ ‘প্রেমেরও এই মেলাতে’। পরবর্তীতে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ চলচিত্রের জন্য লাকী আখান্দের সংগীত পরিচালনায় গান রচনা করেন। এছাড়া দেশে অডিও মিউজিক্যাল ক্যাসেট প্রযোজনার শুরু থেকে অসংখ্য আধুনিক, ব্যান্ড ও কিছু পল্লী গান।

১৯৮০-র দশকে কাব্যচর্চায় প্রত্যাবর্তন। মুদ্রণ ও প্রকাশ অতি সামান্য। ১৯৯৪ থেকে গান লেখা কিছুটা কমিয়ে দিয়ে চিত্রনাট্য ও কবিতায় মনোনিবেশ।

 

১৯৯০-র দশকে অনেকটা ঝোঁকের মাথায় দুটি কবিতা পাঠানো হয় শুধুমাত্র পড়বার জন্য কোলকাতার দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক স্বনামধন্য শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যক্তিগত উত্তরে জানান – একটি কবিতা তিনি তাঁর পত্রিকায় ছাপাতে চান। “কবিদের আসর” সেটি ছাপানো হয় ১৪ জুন ১৯৯৭ সংখ্যা দেশ পত্রিকায়। এ ঘটনা কাব্যচর্চায় উৎসাহ ফিরিয়ে আনে। নতুন নতুন কবিতা লেখা হতে থাকে, স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তার কিছু কিছু প্রকাশিতও হতে থাকে।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী । বাঙালি লেখক, গীতিকবি, কার্টুনিস্ট, চিত্রশিল্পী ও চিত্রনাট্যকার

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৯৯ এ “ঘুম কিনে খাই” কবিতা সংগ্রহটি স্ত্রী সুরাইয়া চৌধুরী ছবি-র মাধ্যমে মধুকুঞ্জ প্রকাশনী বই প্রকাশের দায়িত্ব নেয় এবং ৭ ডিসেম্বর ১৯৯৯ একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বইটি উন্মুক্ত করা হয়। অনুষ্ঠানে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন সঙ্গীতজ্ঞ শ্রী সমর দাস, কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং নাট্য ও কণ্ঠশিল্পী শম্পা রেজা।

মৃত্যু

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ঢাকার ‘ধানমণ্ডি ক্লিনিক’-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment