কাফি গান

কাফি হলো পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের দক্ষিণ এশিয়ার সুফি সঙ্গীতের এক শাস্ত্রীয় রূপ, যা পাঞ্জাবি ও সিন্ধি ভাষায় রচিত হয়। এই ধারার বিখ্যাত কবিদের মধ্যে আছেন বাবা ফরিদ, বুল্লে শাহ, শাহ হুসেইন, শাহ আবদুল লতিফ ভিট্টাই, সাচাল সরমাস্ত ও খাজা গুলাম ফরিদ। কাফি কবিতা শুধু লেখার মাধ্যম নয়, এটি গান হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।

বছরের পর বছর ধরে কাফি কবিতা ও গানের ধারা দ্রুত বিকশিত হয়েছে। বিভিন্ন কবি ও গায়ক তাঁদের নিজস্ব প্রভাব যোগ করে এক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় শিল্পশৈলী সৃষ্টি করেছেন। এই সঙ্গীতের মূল বিষয়বস্তু থাকে আত্মা ও স্রষ্টার সংলাপ, যা প্রায়শই মুরিদ (শিষ্য) ও মুর্শিদ (গুরু), কিংবা প্রেমিক ও তার প্রিয়তমার মধ্যকার সম্পর্ক হিসেবে প্রকাশ পায়।

 

শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ

‘কাফি’ শব্দটি আরবি ভাষার ‘কাফিয়া’ (قافية) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ছড়া’ বা ‘কবিতার ছন্দ’। এটি আরবি কবিতার ‘কাসিদাহ’ নামক এক ধরণের একরৈখিক ছন্দবদ্ধ কবিতা থেকে উদ্ভূত, যা মূলত গাওয়ার জন্য লেখা হয়। কাফি কবিতার বিষয় সাধারণত নায়কতুল্য বীরত্বপূর্ণ কাহিনী এবং লোককথার রোমান্টিক গল্প, যেগুলো আধ্যাত্মিক সত্য ও আত্মার তৃষ্ণার রূপকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে।

 

কাফি সঙ্গীত

কাফি সঙ্গীত হলো পাঞ্জাবি ও সিন্ধি ভাষায় কাফি কবিদের গান, যেমন বুল্লে শাহ ও শাহ হুসেইনের রচনাগুলো। এটি একটি ভক্তিমূলক সঙ্গীত, যা মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামী সুফি তরিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দরবেশ বা ফকিররা একক অথবা দলে এই গান পরিবেশন করেন তাদের মুর্শিদের প্রতি নিবেদন হিসেবে।

কাফি গানের শৈলী ভক্তিমূলক এবং জৌলুসপূর্ণ, যা কওয়ালির সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে। তবে কাওয়ালির চেয়ে কাফির সঙ্গীত বিন্যাস সহজসাধ্য হয়—সাধারণত একটুখানি হারমোনিয়াম, একটুখানি তবলা, একটুখানি ঢোলক এবং একজন গায়ক থাকেন। এখানে সুরের চেয়ে গানের কথাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, কারণ কাফির মূল উদ্দেশ্য হলো আধ্যাত্মিক কবিতার গভীরতা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। গানের মূল স্তবক বারবার গাওয়া হয়।

সিন্ধের দরবেশরা প্রথাগতভাবে ‘য়কতারা’ (একতারের বীণা) ও ‘ছাপ্পর’ (কাঠের ক্ল্যাপার) বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন, যদিও আধুনিক গায়কেরা নিজেদের মতো বিভিন্ন রূপ দিয়েছেন।

 

কাফি গানের উত্থান ও প্রসার

১৯৩০-এর দশকে যখন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জনপ্রিয় হয়, তখন পাটিয়ালা ঘরানার উস্তাদ আশিক আলী খান সিন্ধি কাফি গানে ধ্রুপদ রীতি প্রয়োগ করেছিলেন। একই সময়ের সিন্ধি কাফি গায়ক উস্তাদ আল্লাহদিনো নুনারী ছিলেন যাঁর ফিউশন স্টাইল প্রশংসিত।

বিশ্বব্যাপী কাফি সঙ্গীতের খ্যাতি বাড়াতে পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়িকা আবিদা পারভীন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কাওয়ালির মহারথীর মতো পশ্চিমা দর্শকের সামনে কাফি পরিবেশন করেছেন।

সেনাম মারভী (হায়দ্রাবাদ) ও মুরালালা মারওয়াডা (কুচ) যেমন সুফি লোকসঙ্গীতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, তাঁদের কাজ কোক স্টুডিওর মতো বড় প্ল্যাটফর্মেও শোনা যায়।

কাফি হলো আধ্যাত্মিকতা ও প্রেমের এক রূপ, যা কবিতা ও সঙ্গীতের মাধ্যমে আত্মার ও স্রষ্টার গভীর সম্পর্ক ব্যক্ত করে। এটি পাঞ্জাবি ও সিন্ধি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ এবং আজও দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।