বাউল কামাল উদ্দিন বা কামাল পাশা বাংলাদেশী মরমী কবি, গীতিকার, সুরকার, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ভাটি বাংলার বিখ্যাত গায়ক হিসেবে দেশ বিদেশে সমাদৃত স্মরণীয়।
পরিচিতি
প্রায় ছয় হাজার গানের রচয়িতা, ভাটি বাংলার মরমী ভূবনের কালজয়ী সাধক কামাল উদ্দিন বা কামাল পাশা ১৯০১ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বাউল কবি আজিজ উদ্দিন ও মাতার নাম আমেনা খাতুন। কামাল উদ্দিন বাংলাদেশের প্রান্তিক অঞ্চল সিলেট বিভাগের, সুনামগঞ্জ জেলায়, দিরাই উপজেলার, ভাটিপাড়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে তালুকদার বাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মরমী পরিবারে জন্ম নেয়া এই সাধক ছোট বেলা থেকেই তার পিতার কাছে হতে সঙ্গীত চর্চা করেন।
শিক্ষা
কামাল উদ্দিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন ও সঙ্গীত রচনা করতেন। লেখা-পড়ার হাতেখড়ি ভাটি পাড়া গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে নিজ গ্রাম থেকে দূরবর্তী রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এমই, সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেটের এমসি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন তিনি।
এক পর্যায়ে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় হাদিস শাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেন। লেখা পড়ায় উচ্চ মানের ডিগ্রী অর্জন করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি এমএ পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারেননি। এ হতাশার কথাটি তিনি স্বরচিত একটি আঞ্চলিক গানে প্রকাশ করে গিয়েছেন এভাবে,
বলো মোদের সিলেটবাসীর কিসের ভয়
যে জায়গাতে জালাল বাবা শুইয়ে আছেন সব সময়।
আদা হলদি পিঁঁয়াজ রসুন ঐ সিলেটে সব আছে
স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ভাই জায়গায় জায়গায় বসেছে
এ কামাল কয় দুঃখের বিষয় এম.এ পড়ার সুযোগ নয় ।
আন্দোলনে অংশগ্রহন
ব্রিটিশ আমলের জমিদাররা গরিব অসহায় মজুরদের প্রতি বিনা মজুরিতে কাজ করাতো এবং জমিদারের সামনে জুতো পায়ে ও ছাতা টাঙিয়ে কোন গরিব মজুররা চলা ফেরা করলে অসাধারণ জুলুম অত্যাচার করত। জমিদারদের এই প্রথার বিরোদ্ধে কৃষক শ্রমিক সমিতির নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ১৯২২ ইংরেজি থেকে ১৯৪৯ ইংরেজি সাল পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। ঐতিহাসিক এই আন্দোলন নানকার বিদ্রোহ নামে অবহিত।
সম্মাননা
- অপ্রতিদ্বন্দ্বি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে ১৯৬৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসন ও আর্টস কাউন্সিল কর্তৃক শ্রেষ্ঠ বাউল শিল্পীর পদকসহ গানের সম্রাট কামাল পাশা উপাধিতে ভূষিত হন।
- বাউল কল্যাণ পরিষদ সুনামগঞ্জ আয়োজিত সাংস্কৃতিক উত্সবে লোক সংস্কৃতিতে গৌরবোজ্বল অবদানের জন্য এই মহাসাধককে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয় ।
- নানকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদানের জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুনামগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড কর্তৃক দেওয়া হয় মরনোত্তর সম্মাননা পদক ।
- ভোরের কাগজ বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন ২০১১ ইংরেজি সনে মরমী সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য মরণোত্তর সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
গানের ভুবনে
প্রয়াত এই সঙ্গীত সাধকের রচিত “দ্বীন দুনিয়ার মালিক খোদা, এত কষ্ট সয়না, তোমার দীনকে দয়া হয়না” গানটি ভারতের বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। ভাটিয়ালি গানের শিল্পী আব্দুল আলিম,বাউল কামাল পাশা রচিত “প্রেমের মরা জলে ডুবেনা/ওপ্রেম করতে দুদিন ভাঙ্গতে একদিন এমন প্রেম আর কইরোনাগো দরদী” সহ একাধিক গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেছেন।
কামাল গীতি সংগ্রাহক
সাধক কামাল উদ্দিন রচিত সঙ্গীত নিয়ে নতুন প্রজন্মের সাহসি কিছু তরুণ সেচ্ছা-সেবি সংগ্রাহক কয়েটি বই প্রকাশ করেছেন । তার মধ্যে;
- আল – হেলাল কর্তৃক গানের সম্রাট, কামাল উদ্দিন
- ফারুকুর রহমান চৌধুরী কর্তৃককালনী তীরের লোকগীতি
- মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাউল কামাল পাশা গীতিসমগ্র
- মরমী গানে সুনামগঞ্জ গ্রন্থ, লোকসাহিত্যে জালালাবাদ গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বইতে বাউল কামালের জীবন দর্শন আলোচনা অথবা গান এবং অনলাইন পত্রিকা সমূহে বাউল কামালের জীবন দর্শন নিয়ে আলোচনা ছাপা হচ্ছে ।
মৃত্যু
এলাকার নির্বাচিত সাংসদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ছাড়াও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে রাজধানীর পিজি হাসপাতালে তাঁকে চিকিত্সাসেবা দেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর সাথেও এই কবি প্রতিভার পরিচয় ছিল। প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী এই বাউল সাধক ১৯৮৫ ইং সনের ৬ এপ্রিল মোতাবেক ১৩৯২ বাংলার ২০ বৈশাখ শুক্রবার রাত ১২ টায় নিজ বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন।
আরও দেখুনঃ