দুর্গা পূজার ঢাক | Durga Pujar Dhak

দুর্গাপূজা হিন্দু সপ্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সময় নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক বিশাল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী। দুর্গাপূজার উৎসবে প্রতিটি উপকরণ, পদক্ষেপ ও ক্রিয়াকলাপই একটি নির্দিষ্ট অর্থ বহন করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও আত্মিক স্পন্দন জাগানো উপাদান হলো — ঢাক

ঢাক, দুর্গাপূজার হৃদয় ও প্রাণের প্রতীক। ষষ্ঠী থেকে দশমীর প্রস্থান পর্যন্ত, প্রতিটি মূহূর্তে ঢাকের ধ্বনি মানুষের মনকে অনুরণিত করে, ভক্তি, আনন্দ ও উদ্দীপনা উদ্দীপ্ত করে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, বাংলাদেশ, আসাম, উড়িষ্যা এবং ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশেও দুর্গাপূজার সময় ঢাকের ঢেঁকুর হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে। এটি কেবল বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাস, আধ্যাত্মিক অনুভূতি এবং সামাজিক সংযোগের প্রতীক।

 

দুর্গা পূজার ঢাক

ঢাকের শারীরিক গঠন ও বাদ্যযন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

ঢাক মূলত একটি মেম্ব্রোফোন ধরনের বাদ্যযন্ত্র, যা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত।

  • ঢাক সাধারণত নলাকার আকৃতির হয়, তবে এটি ব্যারেলের মতো সম্পূর্ণ গোলাকার নয়।

  • মুখের ওপরে প্রসারিত করা ছাপ বা আড়াল ঢাকের শব্দের উচ্ছ্বাস ও তীব্রতা বাড়ায়।

  • ঢাককে ঘাড় থেকে ঝোলানো, কোমরে বাঁধা বা মাটিতে রাখা যায়।

  • বাম পাশটি ভারী আওয়াজের জন্য লেপ বা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে।

  • ঢাক বাজানোর জন্য কাঠের দুইটি লাঠি ব্যবহার করা হয়, যা দিয়ে তীব্র ও মনোমুগ্ধকর ছন্দ তৈরি হয়।

ঢাকের এই নির্মাণশৈলী এবং বাজানোর ধরন নিশ্চিত করে যে, ঢাকের শব্দ দূরবর্তী স্থানে থেকেও শোনা যায় এবং ভক্তদের মধ্যে এক ধরনের একাত্মতা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।

 

ঢাক দুর্গা পূজার ঢাক | Durga Pujar Dhak

 

দুর্গাপূজায় ঢাকের প্রাসঙ্গিকতা

দ্য স্টেটসম্যান লিখেছেন:

“দুর্গাপূজা ঢাকের পাগলা বিট ব্যতীত উৎসবের আমেজ ধরা সম্ভব নয়। পুরুষরা তাদের ঘাড়ে ঝোলানো ঢাক নিয়ে, শ্রোতাদের মধ্যে পাগলা ছন্দ ছড়িয়ে দিয়ে উৎসবের দৃশ্যমানতা ও আধ্যাত্মিকতার গভীরতা বাড়ান। এই ধ্বনির মন্ত্রমুগ্ধ প্রহার দর্শনীয় স্থান ও দুর্গাপূজার আনন্দকে সম্পূর্ণ করে।”

শুধু দর্শনের আনন্দ নয়, ঢাকের ছন্দ মানুষের অন্তর ও মনকে উৎসাহিত করে। এটি ভক্তদের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক ও নৃত্য-সংগীতময় আন্দোলন ঘটায়।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ঢাকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

গবেষকরা স্বীকার করেছেন, ঢাক এবং অন্যান্য লোকবাদ্যযন্ত্রের প্রাচীনতা বহু যুগ আগে। আদিম সমাজে মানুষ আনন্দ ও উৎসব উদযাপন, হিংস্র পশু তাড়ানো বা শত্রুর আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য ঢাক, দুন্দুভি জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত।

প্রাচীন সাহিত্য এবং প্রত্ননিদর্শন থেকে ঢাকের উৎপত্তি অনুমেয়। প্রাচীনকালে ঢাককে “ডঙ্কা” বলা হতো। শব্দের ধ্বনি থেকে ধীরে ধীরে এর নাম হয় ঢাক। মাটির হাঁড়ি বা কাঠের কাঠামো থেকে তৈরি এই বাদ্যযন্ত্র নাট্যশাস্ত্রেও বর্ণিত। যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে ঢাককে সংকেত বা যুদ্ধে অনুপ্রেরণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সোমপুর মহাবিহার এবং ময়নামতীর ধ্বংসাবশেষে পাওয়া প্রত্ননিদর্শন এবং ফলকচিত্রে ডঙ্কার মতো বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। গবেষকরা মনে করেন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর (দ্রাবিড়, সেনারা) প্রভাবে এ বাদ্যযন্ত্রগুলি বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে স্থায়ীভাবে প্রবেশ করেছে।

 

 

দুর্গা পূজার ঢাক

 

ঢাক ও সামাজিক সংযোগ

ঢাক কেবল বাদ্যযন্ত্র নয়, এটি মানুষের মধ্যে সামাজিক সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। দুর্গাপূজার মণ্ডপে যখন ঢাকের তীব্র ছন্দ বাজে, তখন ভক্তরা কেবল শোনেন না, তারা ঢাকের ছন্দে নিজেদের নাচ, ধ্যান ও প্রার্থনা মিলিয়ে এক সঙ্গে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ঢাকের ছন্দ গ্রামের মেলায়, শহরের মণ্ডপে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে।

ঢাকের প্রভাব ও আধ্যাত্মিকতা

ঢাকের গভীর, প্রাণবন্ত এবং আধ্যাত্মিক শব্দ মানুষের অনুভূতি ও মনকে স্পর্শ করে। এটি বাঙালির আত্মিক জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ঢাক শোনার সময় মানুষের মনের আভ্যন্তরীণ স্পন্দন এবং সংস্কৃতিক আবেগ একত্রিত হয়। এতে শোনার আনন্দের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্কও উজ্জীবিত হয়।

সমকালীন ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

আজকাল ঢাক শুধুমাত্র দুর্গাপূজা মণ্ডপে নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বাঙালি কমিউনিটি ঢাকের ছন্দ এবং রীতিনীতির মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে। আন্তর্জাতিক উৎসবে ঢাকের বাজনা বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

 

দুর্গা পূজার ঢাক শিক্ষা :

 

দুর্গাপূজার ঢাক কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়; এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক অনুভূতি এবং সামাজিক সংযোগের প্রতীক। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিটি ছন্দ, প্রতিটি তাল, প্রতিটি ঢাকের প্রহার বাঙালির জীবনে আনন্দ, ভক্তি এবং ঐক্য আনতে সাহায্য করে। প্রাচীনকালের যুদ্ধ-সঙ্কেত থেকে শুরু করে সমকালীন সাংস্কৃতিক মঞ্চ পর্যন্ত, ঢাক বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার অঙ্গ হিসেবে আজও জীবন্ত।

Leave a Comment