Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

পল্লীগীতি – সঙ্গীত শৈলী [ Palligiti, Music Genre ]

আজ সঙ্গীত শৈলী পল্লীগীতি পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের জীবনধারা নিয়ে সহজ-সরল আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানক। গ্রামীণ মানুষের গার্হস্থ্য আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, চাওয়া-পাওয়া, প্রেম-ভালোবাসা, সফলতা-ব্যর্থতা, মিলন-বিরহ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রকৃতি, ফুল-ফল, মাছ-পশু-পাখি ইত্যাদি হচ্ছে পল্লীগান বা পল্লীগীতি রচনার বিষয়বস্তু।

অনেক সংগীতগুণীজনের মতে, নিভৃত পল্লীগায়ের মাটি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব চিত্রকে সহজ-সরল বাণী ও সুরে আবদ্ধ করে সৃষ্ট গানকেই পল্লীসংগীত বা পল্লীগীতি বলা হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো সংগীতজ্ঞ বলে থাকেন লোকসংগীতকেই অভিহিত করা হয়েছে পল্লীসংগীত বা পল্লীগীতি নামে।

 

 

অপরপক্ষে সংগীতগুণীজনদের কেউ কেউ পল্লীগীতি সম্পর্কে বলেন, পল্লীর গীত বা গানগুলো রচনা করেছেন গ্রামের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোককবি এবং গায়কবৃন্দ। তাঁদের জীবনের প্রেম, আনন্দ, বেদনা, সৌন্দর্যবোধ ও তত্ত্বজ্ঞান এতে জড়িয়ে আছে অতি নিবিড়ভাবে। পল্লীবাংলার শত বছরের সাধারণ মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মনন প্রতিফলিত হয়ে ওঠে তাদের লেখনীতে। ঐতিহাসিকদের কাছে যা সাধারণের জীবনযাত্রা বা জনপদের ইতিহাস রচনার এক অমূল্য উৎসবিশেষ।

উক্ত বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণকারী সংগীতগুণীজনেরা ধারণা করেন, পল্লীগান রচিত হয়েছে মরমিয়া সাধনার হাত ধরে। ইসলামী অধ্যাত্ম সাধনার পূর্বে বৈদিক যুগ থেকে একটি বিশিষ্ট মরমিয়া সাধনা প্রচলিত ছিল ভারতবর্ষে। অবশ্য বৌদ্ধ ধর্মে এই মরমিয়া সাধনা একটি নতুন রূপ নেয়। এই মতানুসারী সংগীতমণ্ডলী পল্লীগীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, পল্লী অঞ্চলে প্রচলিত সুরে যে গান গীত হয় সেগুলোই হচ্ছে পল্লীগান। গায়ের লোককবি বা স্বভাবকবিরা যে পল্লীগীতি রচনা করেন তার ভণিতায় অনেক সময় রচয়িতার নামও পাওয়া যায়।

পল্লীগীতি লোকমুখে প্রচারিত এবং প্রসারিত হলেও এই ধারার গানগুলোর গীতিকার ও সুরকারের নাম প্রায়শই জানা যায়। তবে অনেক সময় সুরকারের নাম পাওয়া গেলেও গীতিকারের নাম অজানা থেকে যায়। সে গানগুলোকে তখন সংগৃহীত পল্লীগীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। পল্লী অঞ্চলের এই গানগুলো হয়ে থাকে শাস্ত্র ও ব্যাকরণের শাসনমুক্ত এবং এর বাণী, সুর, লয়, তাল ইত্যাদি সরল প্রকৃতির ও জটিলতামুক্ত।

অধ্যাত্মপূর্ণ বাণী সমৃদ্ধ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পল্লীগীতি উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো –

পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই ॥

সেই ঘরখানা যার জমিদারি আমি পাই না তাহার হুকুম জারি।
আমি পাই না জমিদারের দেখা মনের দুঃখ কারে কই (আমি)
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই ॥

জমিদারের ইচ্ছামতো দেই না জমি চাষ
তাই তো ফসল ফলে না রে দুঃখ বারো মাস।

আমি খাজনাপাতি সবই দিলাম আমি চলি যে তার মন জোগাইয়া
তবু জমিন আমার হয় যে নিলাম দাখিলায় মিলে না সই (তবু)
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই ॥

[গীতিকার ও সুরকার : আব্দুল লতিফ, শিল্পী আব্দুল আলীম, তাল ঝুমুর (৬ মাত্রা)।]

ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের পল্লীগানগুলো অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সমাদৃত। বিষয়বস্তু অনুযায়ী এগুলোকে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়।

 

পল্লীগীতির বিভাগ [ Classification of Palligiti ]:

অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পল্লীগীতি :

গ্রামাঞ্চলের মেলা, পার্বণ, ব্রত ইত্যাদি উপলক্ষে রচনা করা হয়ে থাকে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বা আনুষ্ঠানিক পল্লীগীতি।

ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পার দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া ॥

ধান বেচিয়া কিনুম শাড়ী, পিইন্দা যামু বাপের বাড়ি রে
খারে বিলে আইলে পানি, নায়ে ছইয়া দিয়া ॥

চক্ বাজারের চিকন চুড়ি আইনা দিমু হাতে
মগবাজারের মিহিন মিশি দিমু চিরল দাঁতে ॥

বাড়ি আইলে ইষ্টিকুটুম, এই না ধানের গুঁড়ি কুটুম রে
পিঠা পায়েস খাইমু মোরা পাড়া পড়শী লইয়া ॥

[বাণী : সংগৃহীত, সুর : প্রচলিত, তাল: ঝুমুর (৬ মাত্ৰা)।]

 

 

কর্মমূলক পল্লীগীতি :

গ্রামীণ মানুষের জীবিকা বা পেশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেমন গরুর গাড়ি চালানো, গৃহ নির্মাণ করা, জাল ফেলে মাছ ধরা, ঢেঁকিতে ধান ভানা, ধান রোপণ করা বা কাটা, নদীতে নৌকা চালানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত হয় কর্মমূলক পল্লীগীতি।

কত কষ্ট কইরা আমি কামাই রোজগার করে আনি
তবু বুইড়ার মন পাইলাম না রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে
পরানের বান্ধব রে বান্ধব ॥

কোদালে কাটিয়ে মাটি হাতুড় দিয়া পাথর কাটিরে
মাথার ঘাম পায়ে ফেলি তবু দুঃখ গেল নারে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে ।।

চা বাগানে একলা জীবন মর্ম ব্যথা দেয় যে কেবল
পিঠে রেখ্যা বাঁশের ঝুড়ি সবুজ চায়ে ঘানি কুড়িরে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে ॥

ভেব্যে সাধক ওয়াহেদ বলে পাতার বাহার দেখ্যে দেখ্যে
চড়ায় নালায় গোসল করে কত নারীর জীবন গেলরে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে।।

[গীতিকার ও সুরকার : শেখ ওয়াহেদ, শিল্পী ডলি সায়ন্তনী, তাল: কাহারবা (৮ মাত্রা)।]

ইউটিউব লিংক এ ক্লিক করে পুরো গানটি শুনুন : কত কষ্ট কইরা আমি কামাই রোজগার করে আনি

 

কাহিনিমূলক পল্লীগীতি :

রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, বিষাদসিন্ধু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ ইত্যাদি কাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়ে থাকে কাহিনিমূলক পল্লীগীতি।

ভ্রমর কইও গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া ॥

ভ্রমর রে, কইও কইও কইও রে ভ্রমর কৃষ্ণ রে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যামু কৃষ্ণহারা হইয়া রে ভ্রমর কইও গিয়া ॥

ভ্রমর রে, আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর যাইবারে ছাড়িয়া
মাথার কেশর দুইভাগ করে রাখিতাম বান্দিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া ॥

ভ্রমর রে, ভাইবে রাধা রমণ বলে শুনরে কালিয়া
নিভা ছিল মনের আগুন কে দিল জ্বালাইয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া ॥

গীতিকার ও সুরকার : রাধা রমণ, শিল্পী দিলরুবা খান, তাল: কাহারবা (৮ মাত্রা)।]

 

 

তত্ত্বমূলক পল্লীগীতি :

সৃষ্টিকর্তার কথা, তাঁর সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য, সৃষ্টির পরিণতি, রাসুল, নবী, ইহকাল, পরকাল, দেহতত্ত্ব ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে রচনা করা হয়ে থাকে তত্ত্বমূলক পল্লীগীতি।

দুয়ারে আইসাছে পালকি নায়োরি গাও তোলো রে, তোলো
মুখে আল্লাহ রসুল সবে বলো, ও মুখে আল্লাহ রসুল সবে বলো ॥

দুই কান্ধে ছিল যে তোমার দুইজন পাহারা
তোমারে একেলা থুইয়া পালাইছে তাহারা।
তোমার আট কুঠুরি নয় দরজা বন্ধ যে ওই হলো রে, হলো
মুখে আল্লাহ রসুল সবে বলো ॥

দিবানিশি যে ছয়জনা দিত কুমন্ত্রণা
আজ তাহারা কোথায় গেল ভাব দেখিরে মনা।

ফেরেস্তা আসিয়া যখন জিজ্ঞাসা করিবে
দীন কী তোমার মাবুদ কেবা তখন কী বলিবে।
ওরে আল্লাহ বিনে মাবুদ নাইরে জবানে তাই বলো রে বলো
মুখে আল্লাহ রসুল সবে বলো |

[গীতিকার ও সুরকার আব্দুল লতিফ, শিল্পী আব্দুল আলীম, তাল ঝুমুর (৬ মাত্রা)।]

 

 

দৈব মহিমা-সংবলিত পল্লীগীতি :

সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা, দেব-দেবীর গুণকীর্তন, মনসা, চণ্ডী ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয় দৈব মহিমা-সংবলিত পল্লীগান।

এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া
এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই।।

ছায়াবাজি পুতুল রূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচে পুতুলের কী দোষ।
যেমনি নাচাও তেমনি নাচে তুমি খাওয়াইলে আমি খাই।
আল্লাহ তুমি খাওয়াইলে আমি খাই ৷

তুমি বেহেস্ত তুমি দোজখ তুমি ভালো মন্দ
তুমি ফুল তুমি ফল তুমি তাতে গন্ধ।
আমার মনে এই আনন্দ কেবল আল্লাহ তোমায় চাই।
আমি কেবল আল্লাহ তোমায় চাই ॥

তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর
সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়।
তুমি বাঁচাও তুমি মার তুমি বিনে কেহ নাই
আল্লাহ্ তুমি বিনে কেহ নাই ॥

[বাণী: সংগৃহীত, সুরকার মমতাজ আলী খান, শিল্পী আব্দুল আলীম, তাল: কাহারবা (৮ মাত্রা)]

 

 

পারিবারিক পল্লীগীতি :

বিবাহ অনুষ্ঠান, মাতৃগর্ভ ধারণ, শিশুর জন্মলাভ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে রচিত হয় পারিবারিক পল্লীগীতি।

আরে, লীলাবালি লীলাবালি ভরা যুবতী সইগো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে ॥

আরে, মাথা চাইয়া টিকলা দিমু, জড়োয়া লাগাইয়া সই গো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে !

আরে, পিন্দন চাইয়া শাড়ি দিমু, ওড়না লাগাইয়া সই গো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে ॥

আরে, কানও চাইয়া কানফুল দিমু, পান্না লাগাইয়া সই গো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে ॥

আরে, নাকও চাইয়া বেসর দিমু, সনিয়া লাগাইয়া সই গো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে ॥

আরে, হাতও চাইয়া বালা দিমু, মতিয়া লাগাইয়া সই গো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে।

আরে, পাও চাইয়া পা জোড় দিমু, ঘুঙুর লাগাইয়া সই গো।
কী দিয়া সাজাইমু তোরে ॥

[বাণী: সংগৃহীত, সুর: প্রচলিত, শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, তাল: কাহারবা (৮ মাত্রা)।]

 

প্রকৃতি সম্পর্কিত পল্লীগীতি :

ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাভূমিতে ষড়ঋতুর (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত) বর্ণনা, আকাশ, নদী, পাহাড়, সাগর, বন-বনানী ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয় প্রকৃতি সম্পর্কিত পল্লীগীতি।

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে |

আসমান হইল টুডা টুডা, জমিন হইল ফাড়া
মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে, মেঘ দিব তোর কেডা ॥

হালের গরু বাইন্দা, গিরস্ত মরে কাইন্দা
ঘরের রমণী কান্দে ডাইল খিচুড়ি রাইন্দা ॥

আম পাতা নড়েচড়ে, কাঁঠাল পাতা ঝরে
পানি পানি কইরা বিলে, পানকৌড়ি মরে ॥

ফাইট্টা ফাইট্টা রইছে যত, খাল-বিল-নদ
জলের লাইগা কাইন্দা ফিরে, পঙ্খী জলধি ॥

কপোত-কপোতী কান্দে খোপেতে বসিয়া
শুকনো ফুলের কলি পড়ে, ঝরিয়া ঝরিয়া ॥

[বাণী: সংগৃহীত, সুরকার গিরীন চক্রবর্তী, শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, তাল: কাহারবা (৮ মাত্রা)।]

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

প্রেমমূলক পল্লীগীতি :

গ্রামের মানুষের ব্যক্তিজীবনের ভালো লাগা, ভালোবাসা, মন দেওয়া-নেওয়া, মিলন-বিরহ এসবকে কেন্দ্র করে রচনা করা হয়ে থাকে প্রেমমূলক পল্লীগীতি ।

কেমনে ভুলিব আমি, বাঁচি না তারে ছাড়া
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা (সখি গো) ॥

না আসিলে কালো ভ্রমর, কে হবে যোবোনের দোসর।
সে বিনে মোর শূন্য বাসর, আমি কি জীবন্ত মরা ।।

কুলো মানের আশা ছেড়ে, মনো প্রাণ দিয়াছি যারে।
এখন সে কান্দাইয়া মারে, এই কি তার প্রেমের ধারা ॥

আসার পথে চেয়ে থাকি, যারে পাইলে হব সুখী।
এই গরিবের মরণ বাকি, হইল না অধর ধারা ॥

[গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী শাহ আব্দুল করিম, তাল: কাহারবা (৮ মাত্রা)।]

 

বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে এরকম প্রচুর পল্লীগীতির সম্পদ। বর্তমানে সামাজিক গণমাধ্যমের কারণে অনেকটা জনসমক্ষে আসছে। তবে আরও অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন। সেই সাথে প্রয়োজন ভালো শিল্পীদের দিয়ে মানাসই সঙ্গীত আয়োজনে জিনিসগুলো গেয়ে প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া।

পল্লীগীতি – সঙ্গীত শৈলী [ Palligiti, Music Genre ]

আরও পড়ুন:

Exit mobile version