বাংলাগানের বিবর্তনের ইতিহাসে পাঁচালী গানের অবস্থান একটি সার্থক রচনা বলা যেতে পারে। পাঁচালী শব্দটি কেবল বঙ্গদেশেই ব্যবহার করা হয়। সাঙ্গীতিক উপকরণের দিক দিয়ে পাঁচালী বিবর্তিত। বাংলাগানের ক্রমবর্ধমান বিভপ্তিতে পাঁচালী সমৃদ্ধের পথে পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা গীতিকবিতার অবস্থান তথা এর বাহ্যিক উপস্থাপনের যে ধারাবাহিকতা পাঁচালী তারই অংশবিশেষ। পাঁচালীর গ্রহণযোগ্যতা গ্রামীণ পর্যায়ের হলেও বাংলা গানের ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় পাঁচালীর গুরুত্বও বয়েছে। সে প্রশ্নে নিম্নে পাঁচালীর সাঙ্গীতিক বিন্যাসকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
পাঁচালী গান
পাঁচালী বলতে ঘটনাবহুল কোনো কাহিনী প্রকাশের সূত্রে নির্দিষ্ট কোনো আধ্যাত্মিক বা আধিভৌতিক তত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ বর্ণনার নির্দিষ্ট পদ্ধতি হলো পাঁচালী। ধাতুগত অর্থে দেবমাহাত্ম্যসূচক কাহিনীধর্মী গান বাংলা পাঁচালী বলে পরিচিত।
পাঁচালী গানের উদ্ভব:
পাঁচালী ‘পঞ্চলিকা’ শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছে। কারো মতে, পুতুল নাচের সংশ্লিষ্ট গান থেকে পাঁচালী এসেছে। কেউ বলেন পাঁচজন গায়ক চামর হাতে নিয়ে পাঁচালী ছন্দে যা গাইতেন তাই পাঁচালী। পাঁচালীর উদ্ভব মধ্যযুগে হয়েছে একথা বলার কারণ মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে পাঁচালির একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বর্তমানে বরিশালের গৈলা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন কবি বিজয়গুপ্ত। তিনি মনসা দেবী সম্পর্কে অপূর্ব ধারণা প্রচার করেন মনসা মঙ্গলের সূত্রে। বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের প্রনয় ঘটিত, মনসা দেবীর মাহাত্ম প্রকাশ করে মনসামঙ্গল রচিত হয়।
পাঁচালীর দুটি পদ্ধতি:
(১) পাঁচালী পাঠ অর্থাৎ যাকে বলে কথকতা।
(২) যেখানে গানের সুরে, কোথাও যন্ত্র ব্যবহার করা হয় এবং কখন বিনাযন্ত্রে গাওয়া হয়ে থাকে।
পাঁচালীর উল্লেখযোগ্য নাম:
পাঁচালীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মনসার পাঁচালী, ধর্মঠাকুরের পাঁচালী, সত্য নারায়ণের পাঁচালী, লক্ষ্মীর পাঁচালী, শনির পাঁচালী, রামায়ণের পাঁচালী ইত্যাদি। এ ছাড়া রচয়িতা নিজের লেখনী তথা কল্পনার ভিত্তিতে যে-সব গান রচনা করেছেন তাকেও পাঁচালী বলা হয়। যেমন- দাশরথিরায়ের পাঁচালী, গোবিন্দ ওঝার পাঁচালী, নীলকন্ঠের পাঁচালী ইত্যাদি।
পাঁচালী গানের ঘটনা বিশেষ:
পাঁচালী গানে ঘটনার বর্ণনাই হলো মুখ্য। আর বর্ণনার মাধ্যমে বিশেষ ধরনের ভাবসৃষ্টির প্রচেষ্টা ও সেই সূত্রে কোনো নির্দিষ্ট দেবদেবীর পূজা প্রকরণ প্রবর্তনের চেষ্টা চলতে থাকে।
পাঁচালীতে ব্যবহৃত ভাষা:
ভাষার দিক থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাচীন গ্রাম্য বাংলাভাষার ব্যবহার করা হয়। বাংলাভাষা ব্যবহারের কারণে পাঁচালীর দ্রুত বিন্যাস ঘটে। সহজভাষার সাথে রয়েছে এতে সুরের চটুলতা যার ফলে পাঁচালী সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ যোগ্যতা পেতে থাকে।
পাঁচালীতে ব্যবহৃত ছন্দ:
পাঁচালীতে মূলত দুটি কাব্যিক ছন্দের ব্যবহার হয়। একটি পয়ারছন্দ এবং অপরটি ত্রিপদী ছন্দ। পয়ার ছন্দ ৪/৪ বিভাজনে গাওয়া হয়। আর ত্রিপদী অর্থাৎ ৩/৩দাদরা ছন্দে গাওয়া হয়। আবার কোনো ক্ষেত্রে তেওঁরা অর্থাৎ ৩/২/২ ছন্দেও গাওয়া হয়ে থাকে। চর্যাপদ যেহেতু বাংলা কাব্য ও সঙ্গীতের আদি নিদর্শন সে কারণে পরবর্তীতে বিবর্তিত সকল ধরনের গানেই চর্যায় ব্যবহৃত ছন্দশৈলীকে অনুসরণ করা হয়েছে।
পাঁচালীর সাঙ্গীতিক গুরুত্ব:
পাঁচালীর জন্মলগ্ন হতে সাঙ্গীতিক দিক থেকে কোনো গুরত্বও ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে দাশরথি রায়ের গানে কিছুটা সাঙ্গীতিক গুরুত্ব আরোপিত হয়। ফলে পাঁচালী পর্যায়ের গানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কিছুটা হলেও বাড়তে থাকে।
পাঁচালীতে ব্যবহৃত তাল:
পাঁচালী গানে কার্ফা, ঠুংরী, দাদরা, ঝাপতাল, একতাল, তেওড়া, পূর্ববঙ্গীয় লোফা প্রভৃতি তালের ব্যবহার দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হাওড়া জেলার কোনো স্থানে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচলিত আছে। পশ্চিম বাংলার বহু অঞ্চলে বিষহরির পূজার প্রচলন রয়েছে। বিষহরি মনসারই আরেক নাম। এই বিষহরি দেবীকে নিয়ে মহিলারা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে মাগন মেগে বেড়ায় আর সঙ্গে বিষহরির পাঁচালী পাঠ করে।
মনসাদেবীর পূজার বিশেষ প্রচলন অবশ্য সব জায়গাতেই দেখা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি বিভিন্ন নামে পূজিতা। নদীয়া অঞ্চলে মনসা নামে, পূর্ববাংলায় রয়ানী, পুরুলিয়ার মনসা গানের নাম ঝাঁপান, বর্ধমান ২৪ পরগনা অঞ্চলে বিষহরা ইত্যাদি। ঝাঁপান গানের দুটি বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ একটি গানের দুটি ভাগ। একটি তেওড়া ও অপরটি দাদ্রা ছন্দে গীত হয়।
কবি কৃষ্ণরামের প্রসিদ্ধ পাঁচালী:
প্রসিদ্ধ ‘রায়মঙ্গল কাব্য’ ১৩৮৬ সালে কবি কৃষ্ণরাম রচনা করেন। কথিত আছে বামদেবতা দক্ষিণ রায়ের নির্দেশে এই কাব্য রচিত হয়। এটি দক্ষিণ রায়ের পাঁচালী হিসাবে প্রসিদ্ধলাভ করে। দক্ষিণ রায়ের পাঁচালী গানের একটি নমুনা নীচে দেওয়া হলো
রজনীর শেষে এই দেখিলাম স্বপন
বাঘপৃষ্ঠে আরোহণ এক মহাজন
করে ধনুঃশব চারু সেই মহাকায়
পরিচয় দিলামারে দক্ষিণেশ্বর রায়।
সানঝার পাচালী :
পশ্চিম বঙ্গের মালদহের আইহো গ্রামে সানঝা নামে একপ্রকার গানের প্রচলন আছে। একে সানঝার পাঁচালী বলা হয়। সানঝা কথার অর্থ হলো সন্ধ্যা বেলা। অর্থাৎ সন্ধ্যা বেলাকেই দেবীরূপে কল্পনা করে তাঁর পূজা করা হয়। পুরো বৈশাখ মাস ধরে সানঝার পূজা ও পাঁচালী পাঠ করা হয় ।
যেমন :
রঙের বাজনা বাজারে
আরে বাজেরে শঙ্খের ধ্বনি
আরে আরে বাজেরে উলুধ্বনি
ছাওয়াল সানঝার বিয়া দিবরে
ওরে বাজ রঙের বাজনা বাজেরে।
সোনারায়ের গান :
উত্তর বাংলায় সোনা রায়ের গান নামে একপ্রকার গানের প্রচলন দেখা যায়। এ সকল গান মঙ্গল কাব্যের আকারে গাওয়া হয়। পূজা, প্রচার এবং ঠাকুরের মাহাত্ম্য কথা সোনা রায়ের পাঁচালী নামে প্রসিদ্ধ। এই পাঁচালীর দুটি ভাগ প্রথমাংশে সোনা রায়ের জন্ম ও বাল্যলীলা এবং পরবর্তী অংশে সোনা রায়ের পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচার।
সোনা রায়ের পাঁচালী গানের নমুনা নিম্নরূপ :
“যদিয়ে গোয়ালের নারী মুই এনাম পাকিরাও
ধর্মক সহয়করি পূত্রবর নেঞে।
মুঞি যদি গোয়ালের নারী এনাম পাবাঞো
ধর্ম আরতিয়া মুঞি পুত্রবর নেঞে”
ভাদুগানকে অনেকে পাঁচালীর অংশ বিশেষ বলে মনে করেন। ভাদ্রমাসের প্রথমদিন হতে আরম্ভ করে সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি রাত্রিতে পরিবারের প্রধানত কুমারী কন্যারা একত্রিত হয়ে ভাদুপূজা বা মাহাত্ম বর্ণনা করে। সাধারণত বাঁকুরা পুরুলীয়া, পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণ বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ভাদুপূজার প্রচলন রয়েছে।
ভাদুগানের উদাহরণ
আমার ভাদু দক্ষিণ যাবে, খিদে লাগলে খাবে কি
আনো ভাদু গায়ের গামছা মিঠাই সন্দেশ বেঁধে দি।।
মিঠাই সন্দেশ খেয়ে ভাদু গরম জল আর খেয়ে না
সোজা রাস্তায় চলে যাবে কারো পানে চেয়ে না ।।
পাঁচালী গানের বিষয়:
পাঁচালী গান মূলত সনাতন ধর্ম অনুসরণে রচিত। মাহাত্মসূচক পাঁচালীর মধ্যে বিশ্বমঙ্গলের গান, সাবিত্রী সত্য বানের পালা প্রভৃতি স্থান লাভ করেছে। রাধাকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্যদেব বিষ্ণু-প্রিয়া, লক্ষ্মী-নারায়ণ, রাম-সীতা এছাড়াও পাঁচালীর বিষয়বস্তুতে রয়েছে গীতা, মহাভারত ও রামায়ণের বিবিধ প্রসঙ্গ ।
মুসলিম সম্প্রদায় ও পাঁচালী:
মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বহু মুসলমান প্রচলিত কাব্য পাঁচালী আকারে গীত হতে শোনা যায়। মুসলমান সমাজে এগুলি সাধারণত জারি গান হিসাবে গীত হয়। জারি গানে অবশ্য নৃত্যও আছে, কিন্তুপাঁচালীতে নৃত্য নেই। জারি গানগুলোও পাঁচালী আকারে গীত হয়। যেমন ঃ
মহোরমের দশ তারিখে কি ঘটালো রাব্বানা। (আল্লা)
কলিজা ফাটিয়া যায়গো কহিতে তার ঘটনা ।।
হাসান মইল জহরতে
হুসেন সহিদ কারবালায়
জয়নাল আবেদীন বন্দীলো হইলো
এজিদেরই জেল খানায় ।।
মইরোনা মইরোনাগো জয়নাল
জয়নাল তুমি মইরোনা
তুমি জয়নাল মইরাগো গেলে
নবী বংশ রবে না।
পাঁচালী গানে রাগের ব্যবহার:
দাশরথি রায় (১৮০২-১৮৫৭) পাঁচালী গানে রাগসঙ্গীতের মাধুর্য এনেছিলেন। দেবতার মাহাত্ম কীর্তনের আধিক্য বর্জিত হলেও এতে দেবতার কথা পরিত্যক্ত হয়নি। পাঁচালীকার দাশরথি রায় ললিত, বিভাস, সিন্ধুভৈরবী প্রভৃতি রাগ-রাগিনীতে পাঁচালী গান রচনা করেন। তাল হিসাবে যৎ ও ঝাঁপতালের ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন-
দাশরথি রায়ের পাঁচালী
সিন্ধু ভৈরবীতে-
“ঐ দেখো আসছে আয়ান, বংশী বয়ান বনমাঝে
বিপদে যায় হে জীবন, মধুসুদন তোমায় ভজে ।
যারা পাঁচালী রচনা করেন:
দাশরথি রায় ব্যতীত অনেকেই পাঁচালী রচনা করেন। তার মধ্যে ঠাকুর দাস, দ্বারকানাথ, রসিক চন্দ্র, ব্রজমোহন রায়, ঈশ্বরগুপ্ত, সন্ন্যাসী চক্রবর্তী অন্যতম। অষ্টাদশ শতকে ভক্তিরসের সঙ্গে হাস্যরসের মিলন হয়। ভরতচন্দ্র পাঁচালী রচনা করেন, তার রচিত অন্নদামঙ্গল, থেকেই আধুনিক পাঁচালীর সূত্রপাত হয়। পাঁচালী রচিয়তাদের মধ্যে সর্বপেক্ষা শক্তিমান ও প্রভাবশালী ছিলেন দাশরথি রায়। দাশরথির পাঁচালিতে অনুপ্রাসের ঝংকার ও সুর মাধুর্য বৃদ্ধি পেল। নিতান্ত সামাজিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার একটি রচনার প্রথম লাইন নিম্নে প্রদত্ত হলো।
“বিবাহ করিতে হিদি আছে বিধাতার রীতি” এযুগে এখনও বিশেষ করে মহিলারা লক্ষ্মী পাঁচালী, শনির পাঁচালী ও সত্য নারায়ণের পাঁচালী সুরে পাঠ করে থাকেন।
একটি পাঁচালী গানের বাণী উপস্থাপন করা হলো
রচনা দাশরথি রায়, তাল একতাল (ত্রিমাত্রিক )
গিরি গনেশ আমার শুভকারী
আমি পূজে গণপতি পেলাম হৈমবতী
যাও হে গিরিরাজ আনিতে গৌরী।।
বিল্ব বৃক্ষমূলে পাতিয়ে বোধন
গনেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন
ঘরে আনব চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী
কত আসবেন দণ্ডী যোগে জটাধারী
মায়ের কোলে মেয়ে দুইটি রূপসী
লক্ষ্মী সরস্বতী শরতের শশী,
সুরেশ কুমার গণেশ আমার
তাদের না দেখিলে ঝরে নয়ন বারি।
লক্ষ করলে দেখা যায়, পুরাতন বাংলাসাহিত্যের প্রায় সকল কাব্যেই পাঁচালী চঙে গীত হতো। অর্থাৎ এই গান মন্দিরা বাজিয়ে চামর সহযোগে আসরে পরিবেশিত হতো । আর গায়কের পায়ে থাকত ঘুঙুর। কবি কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালী ১২৪০ খ্রিঃ হতে আজ পর্যন্ত বাঙালির কাছ আদরণীয় হয়ে আছে। এ ছাড়া দাশরথি রায়ের ভূমিকা পাঁচালী গানের ক্ষেত্রে অন্যতম। তার ৬০টি পাঁচালী পালা বাংলাগানে এক নবদিগন্তের সূচনা করে। ফলে চর্যাপদ হতে বাংলাগান বিবর্তনের মধ্যদিয়ে আজকে এ অবস্থানে পৌঁছেছে।