প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এক প্রবাদপ্রতিম ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠশিল্পী। বাংলা গানের কণ্ঠশিল্পী জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তথা বাংলা গানের স্বর্ণযুগের মধুকণ্ঠী ছিলেন তিনি।
জীবনী
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বৃটিশ ভারতের কলকাতার টালিগঞ্জে তার মাতুলালয়ে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ডিসেম্বর। আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে। সেখানকার চট্টোপাধ্যায় পরিবার বরাবরই সঙ্গীতে অনুরক্ত ছিল। পিতা মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় চাকুরিসূত্রে সপরিবারে কলকাতার ভবানীপুরে থাকতেন। তিনি গজল,ঠুমরি দাদরায় ছিলেন দক্ষ। প্রতিমা এক বৎসর বয়সেই পিতৃহারা হলে মাতা কমলাদেবীর প্রবল ইচ্ছায় সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। আর্থিক অভাবের মধ্যেও পয়সা জমিয়ে হারমোনিয়াম কিনে ছিলেন এবং প্রথম প্রথম গান শিখতে লাগলেন মায়ের কাছেই। পরে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য বিশিষ্ট সংগীত শিক্ষক প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে।
সঙ্গীত জীবন
প্রকাশকালী নিজের জ্ঞানের সবটাই উজাড় করে সঙ্গীতের পাঠ দিয়েছিলেন প্রতিমাকে। প্রকৃত পক্ষে,সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী ছিল তার ছাত্রী। ছাত্রীভাগ্যে আত্মহারা হয়ে মেয়েটিকে নিয়েও গিয়েছিলেন আপন গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তিনিও প্রতিমাকে কিছু পাঠ দিয়েছিলেন। শৈশবে সাত-আট বছর বয়সে ছুটিতে এক বার ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে।
ঢাকা বেতারে শিশুবিভাগে গান গাওয়ার প্রথম সুযোগ পান। সুকৃতি সেনের কথা ও সুরে ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’,‘মালাখানি দিয়ে আমারে ভোলাতে চাও’গান দু-খানি প্রতিমার কণ্ঠে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সেনোলা কোম্পানি রেকর্ড করে এবং জনপ্রিয়তা পায়। দক্ষিণ কলকাতার ‘মিলনচক্র’ ক্লাবে প্রতিমার গান শুনে যশস্বী শিল্পী-সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তী চমৎকৃত হন।
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তার ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছায়াছবিতে প্রতিমাকে দিয়ে ‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’ গানটি গাওয়ান। আর সেই সাথে নেপথ্যগায়িকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ। তারপর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে’যদুভট্ট’ছায়াছবিতে কুন্দন লাল সায়গলের গাওয়া ‘বাবুল মোরা নইহার ছুট হি যায়ে’ বিখ্যাত গানটি তিনি গেয়েছিলেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের “ঢুলি” চলচ্চিত্রে ( বৃন্দাবনী সারং রাগে) রাগাশ্রিত ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে’ গানটি প্রতিমাকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও অভিভূত হয়েছিলেন। পরে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে হেমন্তর সুরে ‘শাপমোচন’ছায়াছবিতে চিন্ময় লাহিড়ীর সঙ্গে ‘পটদীপ’ রাগে দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেন ‘ ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’। স্বকীয় গায়কির গুণে কঠিন গানেরও সূক্ষ্ম কারুকাজে অনায়াসে বিচরণ করতে থাকলেন তিনি। বলা যায় কয়েক দশক জুড়ে ‘যদুভট্ট, ‘ঢুলি’, ‘শাপমোচন’, ‘ছুটি’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘পরিণীতা’, ‘দাদাঠাকুর’ ইত্যাদি অজস্র ছায়াছবি ভরে আছে প্রতিমার গানে।
অন্যদিকে আধুনিক গানের মধ্যেও তার গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’,’একটা গান লিখো আমার জন্য’ ইত্যাদি অজস্র অবিস্মরণীয় গান তার কণ্ঠে কালজয়ী আখ্যা পেয়েছে। ছায়াছবি, আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ভজন, ভক্তিগীতি, কীর্তন, কাব্যগীতি, অতুলপ্রসাদের গানেও প্রতিমা সমান উজ্জ্বল ছিলেন। কলকাতার আকাশবাণীতে রম্যগীতিও গেয়েছেন।
পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে প্রতিমা ছিলেন এইচ.এম.ভি. শিল্পী। প্রতিমা হেমন্তর সুরে অনেক গান-তো গেয়েইছেন,আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে সবচেয়ে বেশি গান গেয়েছেন। হেমন্ত প্রতিমার গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি প্রতিমার সুরেলা কণ্ঠের প্রশংসা করে বলেছিলেন-
“সে বাঁশরীকণ্ঠী। তাই ‘সা’ থেকে ‘সা’তার চাইতে সুরে আর কেউ গাইতে পারে না!’’
সম্মাননা
প্রতিমা নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসাবে ‘ছুটি’ ‘চৌরঙ্গী’ ও ‘পরিণীতা’ ছায়াছবিতে গানের জন্য পরপর তিন বৎসর বি.এফ.জে.এ. পুরস্কার লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বয়স যখন ১৩ -১৪ বৎসর এবং স্কুলের গণ্ডি পেরোননি তখন সংগীত জগতের অবিস্মরণীয় শিল্পী অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ হয়। তাঁদের এক পুত্র অশোক ও কন্যা রাইকিশোরী। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
জীবনাবসান
শেষ জীবনে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় বাতের ব্যথায় খুবই কষ্ট পেয়েছেন এবং অনেক মানসিক অসুস্থতার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই তিনি কলকাতায় প্রয়াত হন।
আরও দেখুনঃ