Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

বাঁশি কেন গায় লিরিক্স | Banshi Keno Gay Lyrics | সলিল চৌধুরী – লতা মঙ্গেশকর

banshi keno hai with lyrics lata বাঁশি কেন গায় লিরিক্স | Banshi Keno Gay Lyrics | সলিল চৌধুরী - লতা মঙ্গেশকর

বাঁশি কেন গায় গানটির গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরী। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকর জুটি ভারতীয় সঙ্গীতে এক অসামান্য যুগলবন্দি।

বাঁশি কেন গায় লিরিক্স

ও বাঁশি হায় ..
বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়
কে গেছে হারায়ে, স্মরণের বেদনায়
কেন মনে এনে দেয়, আ আ আ..
বাঁশি কেন গায়।

ও বাঁশি
কখনো আনন্দ ছিল জীবনের ছন্দে
হৃদয় মাতাল হত ফাগুনের গন্ধে,
কখনো আনন্দ ছিল জীবনের ছন্দে
হৃদয় মাতাল হতো ফাগুনের গন্ধে।

সে গেল কোথায়?
আমি বা কোথায়?
যদি না জানা, আ আ আ..
বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়
কে গেছে হারায়ে, স্মরণের বেদনায়
কেন মনে এনে দেয়, আ আ আ..
বাঁশি কেন গায়।

ও বাঁশি
তমাল কদম্ব আমার গোপিনী সখিনী
যমুনা উজান গেছে আর তো দেখিনি,
তমাল কদম্ব আমার গোপিনী সখিনী
যমুনা উজান গেছে আর তো দেখিনি।

সবই যদি যায়,
ধূলিতে মিলায়,
তবু কেন হায়, আ আ আ..
বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়
কে গেছে হারায়ে, স্মরণের বেদনায়
কেন মনে এনে দেয়, আ আ আ..
বাঁশি কেন গায়।
ও বাঁশি ….

 

 

Banshi Keno Gay Lyrics

O bashi keno gay amare kaday
ke geshe haraye shoroner bedonay
keno mone ene dey.

O bashi kokhono anondo silo jiboner shonde
hridoy matal hoto faguner gondhe
se jeno kothay ami ba kothay
jodi na jana.

bashi keno gay amare kaday
ke geshe haraye bedonay
keno mone ene dey.

O bashi
tomal kodombo amar gopini sokhini
jomuna ujan geshe arto dekhini||
sadh jodi jay dhulite milay
tobu keno hay.

bashi keno gay amare kaday
ke geshe haraye shoroner bedonay
keno mone ene dey.
bashi keno gay

 

 

গানটি শুনতে:

 

 

 

 

সলিল চৌধুরী ও লতা মঙ্গেশকর জুটি:

এই জুটি নিয়ে আনন্দবাজারে অলক রায়চৌধুরী লিখেছেন:

লতাজি সলিল চৌধুরীর সুরে প্রথমবার বাংলা গান করেন ‘একদিন রাত্রে’ (১৯৫৬) ছবিতে। ‘জাগো মোহন প্রীতম‘ লতাজির গাওয়া এ ছবির বিখ্যাত গান। সলিলদার সুরে লতাজি এরপর গাইলেন বাংলা আধুনিক গান। ১৯৫৯ সালের পুজোতে সলিলদার সুরে লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গানের রেকর্ড বেরোল। সে এক ঐতিহাসিক রেকর্ড। তখন ৭৮ আরপিএম-এর রেকর্ড ছিল, দু-পিঠে দুটো গান। এই রেকর্ডের এক পিঠে ছিল ‘না যেও না রজনী এখনও বাকি’। উল্টোদিকে ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি’।

‘না যেও না রজনী এখনও বাকি’-র হিন্দি ভার্সন সলিল চৌধুরী ১৯৬০ সালে বিমল রায়ের ‘পরখ’ ছবিতে লতাজিকে দিয়েই গাওয়ালেন ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’। এই গানের প্রসঙ্গে আমরা পরে আলাদা করে কথা বলব৷ ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি’ এই গানটাকে অনেক বিশেষজ্ঞ লতা মঙ্গেশকর ও মনোহারী সিং-এর একটা যুগলবন্দি হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ এই গানটা মনোহারী সিং-এর ইংলিশ ফ্লুটের prelude দিয়ে শুরু হয়। তারপর লতাজি গানের মুখরাটা করেন৷ অন্তরা বা interlude-এ আবার মনোহারী সিং-এর স্যাক্সোফোন বেজে ওঠে। এরপর আবার লতাজির কণ্ঠ। এভাবেই পুরো গানটা চলে।

অর্থাৎ লতাজির কণ্ঠ ছাড়াও এই গানে মনোহারী সিং-এর ইংলিশ ফ্লুট আর স্যাক্সোফোন, দুটো ইনস্ট্রুমেন্ট-এর অসামান্য ব্যবহার করা হয়েছে, এ এক আশ্চর্য যুগলবন্দি। এই গানটার হিন্দি ভার্সন সলিল চৌধুরী লতাজিকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘মায়া’ (১৯৬১) ছবিতে। মালা সিনহার লিপ-এ সেই গানটা ছিল— ‘যা রে উড় যা রে পনছি’।

স্টুডিওতে লতা মঙ্গেশকরকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সলিল চৌধুরী

এর পরের বছরেও, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে লতা-সলিলের নন-ফিল্ম গানের রেকর্ড আবার সুপারহিট। পুজোর গানের রেকর্ডের একপিঠে ছিল ‘বাঁশি কেন হায় আমারে কাঁদায়’। উল্টোপিঠের গানটাও সুপারহিট— ‘ওগো আর কিছু তো নাই‘। ‘বাঁশি কেন হায়..’ পরে হিন্দিতে হয়েছিল ‘বনশী কিঁউ গায়’। এই গানটাও বিমল রায়ের ‘পরখ’ ছবিত সলিল চৌধুরী লতাজিকে দিয়ে গাইয়েছিলেন। আর ‘ওগো আর কিছু তো নাই’ গানটার হিন্দি হয়েছিল ‘মায়া’ ছবিতে— ‘তসবির তেরি দিল মে’। গানটা ছিল মহম্মদ রফির সঙ্গে লতাজির ডুয়েট। এই গানটার রেকর্ডিং নিয়েও একটা ঘটনা আছে, আমরা পরে লতাজির হিন্দি গানের প্রসঙ্গে যখন আলোচনা করব, তখন সেটা নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা যাবে।

এর পরের বছরের রেকর্ড আরও ঐতিহাসিক। ১৯৬১-তে সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গান বিক্রির দিক থেকে এক নতুন রেকর্ড স্পর্শ করেছিল। একটা দিকের গান ছিল ‘কী যে করি দূরে যেতে হয়‘, আর অন্যদিকে ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো’। শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতে জনপ্রিয় হয়েছিল এই রেকর্ড, বিশেষ করে এই দ্বিতীয় গানটি। এই প্রসঙ্গে শ্রী রণবীর নিয়োগীর কথা আসবে। পরবর্তীকালে আমরা রণবীরদাকে সলিল চৌধুরীর গানের ভাণ্ডারী হিসেবে জেনেছি।

Salil Chowdhury directing Manna Dey

সলিল চৌধুরীর গান যিনি সবচেয়ে ভালো জানতেন, বুঝতেন, নিজের কাছে সংগ্রহ করে রাখতেন, সংবাদমাধ্যম যাঁর কাছে এসে সলিলদার গানের বিষয়ে জানতে চাইত, রেকর্ড কোম্পানি যাঁর দরজায় এসে পড়ে থাকত, তিনিই এই রণবীর নিয়োগী। এমনকি খোদ সলিল চৌধুরী-সবিতা চৌধুরী নিজেদের পুরনো গান রণবীরদার কাছে ভেরিফাই করতে আসতেন। আমি দীর্ঘদিন রণবীরদার স্নেহ পেয়েছি, তাঁর কাছ থেকে সলিলদার অনেক গল্প শুনেছি।

এই রণবীরদার কাছেই শুনেছি, সেই সময় অর্থাৎ ১৯৬১ সালের পরে যেসব প্রবাসী কলকাতায় আসতেন, তারা বাঙালি হোন কি অবাঙালি, এসে এখানে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে দিনকয়েক থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার সময় আর কিছু না হোক দুটো বাংলা গানের রেকর্ড অবশ্যই কিনে নিয়ে যেতেন। একটি হল পান্নালাল ভট্টাচার্যের ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’ আর দ্বিতীয় রেকর্ডটা ছিল লতাজির ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো’।

এমনকি হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর সলিল চৌধুরীকে বলেছিলেন, সলিলদা যদি ‘সাত ভাই চম্পা’-র সুরটা একটুও না বদলে হুবহু একটা মারাঠি গানে ব্যবহার করতে রাজি থাকেন, তাহলে হৃদয়নাথ একটি মারাঠি ছবি প্রযোজনা করবেন। সলিল চৌধুরী রাজি হয়েছিলেন, এবং শুধুমাত্র একটি বাংলা গানের সুর ব্যবহার করার জন্য ‘শুনবাই’ নামে একটি মারাঠি ছবি তৈরি হল।

তবে সারা ভারতে ‘সাত ভাই চম্পা’-র মূল বাংলা সংস্করণটিই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছিল, অন্য কোনও ভার্সন তার পাশে দাঁড়াতে পারেনি, এমনকি মহারাষ্ট্রে, খোদ লতাজির নিজের জায়গায় তাঁরই গাওয়া মারাঠি সংস্করণটি মূল বাংলা গানের পাশে সেভাবে জনপ্রিয় হতে পারেনি। ‘সাত ভাই চম্পা’ গানটার হিন্দি হয়েছিল ১৯৭২ সালে, রাজশ্রী প্রোডাকশনের ‘মেরে ভাইয়া’ নামে একটি ছবিতে। গানটার হিন্দি রূপ ছিল ‘পেয়াস লিয়ে মনওয়া হামারা ইয়ে তরসে’।

 

Salil Chowdhury Directing Kishore Kumar

১৯৬২ সালে সলিল চৌধুরী ও লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গানের অর্থাৎ বাংলা আধুনিক গানের কোনও রেকর্ড বের হয়নি। রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছিল আবার ৬৩ সালে, সে এক অদ্ভুত ঘটনা। আবারও রণবীরদা, রণবীর নিয়োগী আমাকে একটা গল্প বলেছিলেন। ৬৩ সালে লতাজির জন্য সলিল চৌধুরীর ভাবনা ছিল, একপিঠে ‘কেন কিছু কথা বলো না’, আর এই গানটার ভাবনার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেই, রেকর্ডের উল্টোপিঠে ‘যদি কিছু আমারে শুধাও, কী যে তোমারে কব’। তখন একটা অন্যরকম সময় ছিল, সবাই সবার কাজ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন।

রণবীরদা আমাকে বলেছিলেন, সেই সময় শ্যামল মিত্র এই গানটার কথা জানতে পেরে সলিল চৌধুরীকে গানটা তাঁকে দিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। “সলিলদা, এই গানটা আপনি আমাকে দিয়ে দিন।” সলিলদা বললেন, “এই গানটা তোকে দেব, তাহলে আমি লতাকে কী গাওয়াব? এই গানটা তো লতার জন্য ভেবে রেখেছি।” শ্যামল মিত্রও নাছোড়বান্দা, বললেন, “সলিলদা, আপনার গান গাইবেন লতা মঙ্গেশকর। আপনি ওঁকে দিয়ে যে গান গাওয়াবেন, তা-ই হিট করবে।” সলিল চৌধুরী অবশেষে শ্যামল মিত্রের অনুরোধ মেনে নিলেন এবং গানটি তাঁকে দিয়ে দিলেন।

Lata Mangeshkar & Salil Chowdhury

শেষমেশ কী দাঁড়াল? লতা মঙ্গেশকরের জন্য যে দুটো গান সলিল চৌধুরী ভেবে রেখেছিলেন, অর্থাৎ ‘কেন কিছু কথা বলো না’ এবং ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’, এর মধ্যে থেকে দ্বিতীয় গানটা রইল না। তখন সলিল চৌধুরী ‘কেন কিছু কথা বলো না’ সঙ্গে রাখলেন ‘ও তুই নয়নপাখি আমার রে’। গানটি একটি এস ডি বর্মন ঘরানার গান, কিছুটা লোকসঙ্গীত আধারের। আর শ্যামল মিত্রকে ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ এর সঙ্গে দ্বিতীয় গানটা দিলেন, ‘যাক যা গেছে তা যাক’।

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, লতাজির গাওয়া নিরানব্বই শতাংশ বাংলা গানই বম্বেতে রেকর্ড হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা সলিল চৌধুরী, সঙ্গীত পরিচালক যিনিই হোন না কেন, তিনি বম্বেতে গিয়ে লতাজিকে দিয়ে গান রেকর্ড করিয়ে আসতেন। ৬৩-র পুজোর গান লতাজির কতিপয় বাংলা রেকর্ডের মধ্যে একটি যা লতাজি কলকাতায় এসে রেকর্ড করেছিলেন।

এর আগে ১৯৫৭ সালে লতা মঙ্গেশকর কলকাতায় এসে তাঁর প্রথম পুজোর গান রেকর্ড করে গেছেন। ভূপেন হাজারিকার সুরে ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় প্রকাশ পেয়েছিল সে রেকর্ড— গানদুটি ছিল ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে‘ এবং ‘মনে রেখো‘। কিন্তু রণবীরদা আমাকে বলেছিলেন, ৬৩-এর রেকর্ডের অর্থাৎ ‘কেন কিছু কথা’ ও ‘ও তুই নয়নপাখি‘-র রেকর্ডের যা অডিও কোয়ালিটি হয়েছিল তা নাকি লতাজির একেবারেই পছন্দ হয়নি। তিনি বেশ অসন্তুষ্টই হয়েছিলেন, বলেছিলেন— “ইয়ে কেয়া মেরি আওয়াজ হ্যায়?” যাই হোক, আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতাদের কানে অবশ্য সে হেরফের ধরা পড়ে না এবং এই গানদুটিও বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে আছে।

Salil Chowdhury Playing Guitar

 

এরপরে ক্রমানুসারে না গিয়ে আমরা যে উল্লেখযোগ্য রেকর্ডটির প্রসঙ্গে আসব, সেটি হল ১৯৬৭-র পুজোর রেকর্ড। এর একটা গান ছিল ‘নিশিদিন নিশিদিন বাজে স্মরণের বীণ’। এই গানটা নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল। গানটা ‘মন লাগে না..’ এরকম একটা প্রিলিউড দিয়ে শুরু হয়। আদতে প্রিলিউডটা ইনস্ট্রুমেন্টে রেখেছিলেন সলিল চৌধুরী। কিন্তু লতাজি একটা প্রস্তাব রাখলেন। তিনি বললেন, “সলিলদা, আপনি এখানকার প্রিলিউডটা তুলে দিন, বরং এখানে একটা লিরিক দিন, আমি গাইব।” সলিল চৌধুরী লতাজির কথা খুব মানতেন, মন দিয়ে শুনতেন, কারণ তিনি লতা মঙ্গেশকর। সলিলদা তখন ইনস্ট্রুমেন্টে প্রিলিউডটা সরিয়ে সে জায়গায় কথা ও সুর বসান— ‘না মন লাগে না…’ ইত্যাদি। এই প্রিলিউড লতাজি গান এবং তারপর মূল গানটা শুরু হয় ‘নিশিদিন নিশিদিন বাজে স্মরণের বীণ’।

Salil Chowdhury with Asah Bhosle and Mukesh

 

এবার প্রশ্ন হল ‘নিশিদিন…’-এর উল্টোদিকে কী গান হবে? সেইসময় সলিলদার বন্ধুবান্ধব যাঁরা ছিলেন, অথবা তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট, তাঁরাও খুব বড় মাপের মানুষ ছিলেন— যেমন প্রবীর মজুমদার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। এঁরা সলিলদাকে একটা পরামর্শ দেন। সলিল চৌধুরী ১৯৫৩ সালে একটি বাংলা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, ছবিটার নাম ‘ভোর হয়ে এল’। তাতে দুখানা গান ছিল— একটি মহানন্দ বাউলের গাওয়া, অন্য গানটি গীতা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া। কিন্তু এই দুটো গান ফিল্মেই থেকে গেছিল, রেকর্ড হিসেবে কোনওদিন রিলিজ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই এরকম হত, ছবির গানের রেকর্ড বেরোত না। তা এই ‘ভোর হয়ে এল’ ছবিতে গীতা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটি ছিল ‘কে যাবি আয় ওরে আমার সাধের নায়’। বন্ধুদের পরামর্শে এই গানটা সলিলদা লতাজিকে দিয়ে রেকর্ড করিয়ে নিলেন। ফলশ্রুতিতে আমরা আরেকটা সুপারহিট রেকর্ড পেলাম।

Salil Chowdhury, Mohammad Rafi & Others in Recording

 

১৯৬৯ সালের পুজোর গানের রেকর্ড আরও সাংঘাতিক। সে রেকর্ডের প্রথম গানটি ‘না মন লাগে না‘। গানটা-র অন্তরায় একটা জায়গায় ‘চোখে চোখে চেয়ে থাকা ভালোওওও লাগে না..’ এই ‘ভালো’ শব্দটায় এসে একটা ঝাঁকুনি আছে, যারা গানটা শুনেছেন তারা অবশ্যই মনে করতে পারবেন, এটাও লতাজি নিজের থেকে করেছিলেন এবং সলিলদা সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। উল্টোদিকের গানটা ‘ওরে মনময়না’, সেটাও একটা দারুণ এক্সপেরিমেন্ট। সাধারণত আমরা দেখি, কোনও গান ফ্ল্যাটে শুরু হয়, নিচু স্কেল থেকে উঁচু স্কেলে যায়, আবার নেমে আসে। ‘ওরে মনময়না’ গানটা সলিল চৌধুরী উপর থেকে নিচে নামিয়েছেন। আর এটা এমন এক আশ্চর্য গান যে এর মধ্যে কোনও অন্তরাই নেই। গানটা টানা চলে, গানটা মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যাবে। এইরকম নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট সলিলদা নানা সময় লতাজিকে দিয়ে করিয়েছেন।

Salil Chowdhury Directing Manna Dey and Lata

 

এরপরে আসব ১৯৭১ সালের পুজোর গানে। এই রেকর্ডটা নিয়ে খুব মজাদার একটা গল্প আছে। সলিল চৌধুরী একবার কলকাতায় একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেগাফোন রেকর্ড কম্পানির তৎকালীন কর্ণধার কমল ঘোষ। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় কমলবাবু জানতেন সলিলদার মতো মানুষকে যেকোনও জায়গায় এনে যদি একটু ঠিকঠাক উসকানি দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সৃজনশীল অনেক কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে।

কমলবাবু রেস্টুরেন্টে বসে সলিলদাকে বললেন, “সলিলদা, কোনও গান মাথায় আসছে? এখানে বসে বসে একটু ভাবুন না!” সলিলদা বললেন, “এখানে তো খেতে এসেছি। এটা কি গানের জায়গা?” কমলবাবু তা-ও প্ররোচনা দিয়েই চলেছেন, “দেখুন না, কিছু হয় কিনা!” সলিলদা তখন মেনুকার্ড দেখছিলেন, ঠিক যেমন আমরা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অর্ডার দেওয়ার আগে মেনুকার্ড দেখি ও খাবার খেয়ে বাড়ি আসি। সলিলদাও মেনুকার্ড দেখছিলেন, পরপর চিকেনের আইটেমগুলো লেখা আছে— প্যান ফ্রায়েড চিকেন, মান্ডারিন চিকেন, গারলিক চিকেন ইত্যাদি।

এগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ সলিল চৌধুরীর মাথায় এল— আচ্ছা, এই আইটেমগুলোর প্রতিটা থেকে প্রথম উচ্চারণটা নিয়ে যদি পাশাপাশি লেখা যায়, তাহলে কেমন হয়? যেমন, প্যান ফ্রায়েড চিকেন থেকে ‘পা’ পাওয়া গেল, মান্ডারিন থেকে ‘মা’, গারলিক চিকেন থেকে ‘গা’, এমনিভাবে তৈরি হল গানের প্রথম শব্দগুলো— পা মা গা…। আর এইভাবে ওই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসেই জন্ম নিল— “পা মা গা রে সা তোমার চোখের ভাষা” এই বিখ্যাত গান। আপ্লুত কমল ঘোষ সলিলদাকে টাকা দিতে দিলেন না, নিজেই রেস্টুরেন্টের বিল পেমেন্ট করে দিলেন। যদিও রেকর্ডটা মেগাফোন থেকে বেরোয়নি, বেরিয়েছিল গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে এবং ১৯৭১-এর সেই পুজোর গান আবার সুপারহিট।

 

Salil Chowdhury Directing Kishore Kumar

 

৭২-এর পুজোর গানে আরেক ঘটনা। সেবার ঠিক হয়েছে, পিন্টুদা অর্থাৎ পিন্টু ভট্টাচার্য সলিলদার গান গাইবেন। পিন্টু ভট্টাচার্যের তখন খুব নামডাক। আগের বছর সুধীন দাশগুপ্তের সুরে পিন্টু ভট্টাচার্যের ‘ওই নির্জন উপকূলে’ অথবা তারও আগে নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘এক তাজমহল গড়ো’ অথবা ‘শেষ দেখা সেই রাতে’, অশোক রায়ের সুরে ‘চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে’ প্রত্যেকটা গান সুপারহিট।

৭২ সালে প্রথমবার পিন্টুদা সলিলদার সুরে গান গাইবেন৷ সলিলদা পিন্টুদাকে একটা গান শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন। বললেন, “এই গানটা ভালো করে প্র‍্যাকটিস কর। তারপর অমুক দিন বম্বে যাবি, আমি ওখানে থাকব, আবার রিহার্সাল করাব, সেকেন্ড গানটাও তোকে শেখাব, তারপর দুটো গান একসঙ্গে রেকর্ড হবে।” এই বলে সলিলদা বম্বে চলে গেলেন।

পিন্টুদা বেশ ভালো করে গান প্র‍্যাকটিস করে নির্দিষ্ট দিনে বম্বে রওনা হলেন। বম্বে গিয়ে সলিলদার সঙ্গে পিন্টুদা দেখা করলেন। তখন সলিলদা বললেন, “তোকে এই গানটা দেব বলেছিলাম, কিন্তু তোকে দেব না, ওটা লতা গাইবে।” পিন্টু ভট্টাচার্যের মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল। মন খারাপ করলেন। “সলিলদা, এত আশা করে গানটা আমি শিখেটিখে এলাম, আর আপনি আমায় গানটা দেবেন না?” সেইসময় কলকাতায় আকাশবাণীতে একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হত— রম্যগীতি।

রম্যগীতিতে সলিলদার অনেক গান ছিল, যেগুলো পরে বাণিজ্যিকভাবে রেকর্ড হয়েছে, কিছু গান উনি আবার হিন্দিতেও করেছেন। ৭১ সালে রম্যগীতিতে সবিতা চৌধুরীর একটা গান ছিল, ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি’। রম্যগীতির গান হওয়ায় তার কোনও গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ পায়নি। সলিল চৌধুরী পিন্টু ভট্টাচার্যকে ওই গানটা দিয়ে দিলেন। উল্টোদিকের জন্য একটা গান চাই। তখন ‘আনোখা দান’ ফিল্মে সঙ্গীত পরিচালনা করছিলেন সলিল চৌধুরী। ওতে মান্না দে-র কণ্ঠে একটা গান ছিল ‘মানা কে হ্যায় জিন্দেগি ইয়ে সফর’। এই গানটির সুরেই বাংলা কথা বসিয়ে পিন্টুদাকে সলিলদা রেকর্ড করিয়ে দিলেন ‘ওগো আমার কুন্তলিনী প্রিয়ে’। পিন্টুদা খুশিমনে দুটো গান রেকর্ড করে কলকাতায় ফিরে এলেন।

আর যে গানটা পিন্টুদার প্রথমে গাওয়ার কথা ছিল, যেটা মন দিয়ে প্র‍্যাকটিস করে বম্বে গিয়েছিলেন পিন্টুদা, সেই গানটা সলিল চৌধুরী লতা মঙ্গেশকরকেই দিলেন। গানটা ছিল— ‘কিছু তো চাহিনি আমি।’

Salil Chowdhury and Yesudas, Shashank Chickermane

 

এরপরের যে উল্লেখযোগ্য রেকর্ডটার কথা আমাদের বলতে হবে তা হল ১৯৭৫ সালের। ৭৫ সালের পুজোতে যে গানটা সলিল চৌধুরী লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ালেন তাতে রিদম ইনস্ট্রুমেন্ট তেমন কিছু ছিল না। শুধু দুটো গিটার ছিল, গিটারদুটোর কাজ ছিল তালটা ধরে রাখা। আর একটা ফ্লুট। তবলা বা পারকাশন বলে কিছুই ছিল না গানটায়। গানটা কমপোজ করার পর সলিলদা গানটা বাড়িতে সবিতা চৌধুরীকে শুনিয়েছিলেন। সবিতাদি এই গল্প নিজে আমাকে শুনিয়েছেন, “আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম— এই গানটা কি আমাকে দিচ্ছ? উনি বলেছিলেন— না, না, তোমাদের জন্য অন্য গান। এই গানটা লতার জন্য।” সে গান পঁচাত্তর সালের পুজোর সুপার-ডুপার হিট গান “ও মোর ময়না গো।”

 

Salil Chowdhury and Talat Mahmood

 

এছাড়াও সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকরের যুগলবন্দিতে অনেক কালজয়ী গান সৃষ্টি হয়েছে। শেষদিকে সলিলদা অন্যান্য শিল্পীদের গাওয়া পুরনো কিছু গান লতাজিকে দিয়ে দিয়েছিলেন। রণবীরদার কাছে শুনেছি, পরে লতাজি তা জানতে পেরে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। রিজিওনাল ভাষায় অন্য শিল্পীর গাওয়া পুরনো কোনও গান লতাজি গাইতেন না। অথবা কোনও গান আগে যদি হিন্দি হয়ে যায়, পরে বাংলা হয়েছে, সেই বাংলা গান উনি গাইতেন না। এ বিষয়ে ওঁর একটা স্পষ্ট নীতি ছিল। অন্য শিল্পীর গাওয়া একটামাত্র গানই লতাজি জেনেশুনে খুশি হয়ে রেকর্ড করেছিলেন, তা হল ‘রানার’, যা সলিলদার সুরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অসামান্য জনপ্রিয় হয়েছিল।

পরে লতাজিকে দিয়ে সলিল চৌধুরী গানটা নতুনভাবে রেকর্ড করিয়েছিলেন। এছাড়া জ্ঞানত লতাজি অন্য কোনও পুরনো শিল্পীর গান আর নতুন করে গাননি। না জেনে গেয়েছেন, যেমন, ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি‘ সলিলদা পরে আবার লতাজিকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন, লতাজি পরে সেটা জানতে পেরে একটু মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন।

অথবা শচীন গুপ্তের গাওয়া পুরনো গান ‘এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে..’ লতাজিকে দিয়ে সলিল চৌধুরী নতুন করে গাইয়েছিলেন। সেটাও লতাজি পরে জানতে পেরে খুশি হননি। অবশ্য সলিলদা চলে যাওয়ার পর লতাজি সেইসমস্ত ক্ষোভ আর মনে রাখেননি। কাগজে একটা মন্তব্যও করেছিলেন, “’কেন কিছু কথা বলো না’, ‘নিশিদিন নিশিদিন বাজে স্মরণেরো বীণ’, ‘সাত ভাই চম্পা’, এগুলো তো আমার গান নয়, এগুলো সলিলদারই গান।” লতাজি যাই বলুন, গানগুলি সলিলদার অনবদ্য সুরসৃষ্টি তো অবশ্যই, কিন্তু লতাজির কণ্ঠ ও স্কিল গানগুলিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।

 

Salil Chowdhury and Lata Mangeshkar

 

আধুনিক গানের বাইরেও লতাজি বাংলা সিনেমায় সলিলদার সুরে অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। যেমন ‘মর্জিনা-আবদাল্লা’ ছবিতে। ছবির গল্প ও মুডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরবীয় সুর মেশানো আশ্চর্য কমপোজিশন (‘হায় হায় প্রাণ যায়’) করেছিলেন সলিলদা৷ ‘কবিতা’ ছবিতেও সলিলদার সুরে দারুণ গেয়েছেন লতাজি (‘বুঝবে না, কেউ বুঝবে না কী যে মনের ব্যথা‘)। সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকরের যুগলবন্দি বাংলা গানে যে এক ম্যাজিকাল পার্টনারশিপ, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ]

এবার আমরা হিন্দি ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া নির্বাচিত কিছু গান নিয়ে কথা বলব। আমরা দেখতে পাব সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই জুটি কতগুলি ট্রেন্ড সেট করেছে। আমরা দেখব সুরের ক্ষেত্রে সলিল চৌধুরী কী কী পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, এবং তা কীভাবে গৃহীত হয়েছিল। বিশেষ করে এমন একটা সময় যখন কম্পিউটার নেই, পিচ কারেকশন নেই, গ্রাফিক ইকুয়ালাইজার নেই, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে লতা মঙ্গেশকর একের পর এক যেসব অসামান্য গান উপহার দিয়েছেন, সে কথা ভাবলেই বিস্মিত হতে হয়।

১৯৬৭-র একটা ঘটনার কথা বলে আমরা শুরু করব। ১৯৬৭ সাল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীতজীবনের পঁচিশ বছর পূর্তি। ১৯৪২ সালে মারাঠি গান গেয়ে লতাজি সঙ্গীতজীবন শুরু করেছিলেন। ৬৭-তে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীতজীবনের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বম্বের সন্মুখানন্দ হলে এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে লতাজি তাঁর ওই অবধি কেরিয়ারে নিজের গাওয়া দশটি সবচেয়ে প্রিয় গান গেয়ে শোনাবেন। বলাই বাহুল্য গানগুলির অর্ডার বা ক্রম, কার পরে কোন গানটা গাইবেন— তা লতাজি নিজেই নির্বাচন করেছেন।

লতাজি অনুষ্ঠান শুরু করলেন সলিল চৌধুরীর সুরে বিমল রায়ের ‘পরখ’ (১৯৬০) ছবির গান— ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’। আমরা জানি, এর এক বছর আগেই অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে এই গানের বাংলা ভার্সন বেরিয়ে গেছে— ‘না যেও না রজনী এখনও বাকি’। ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’ গানের মধ্যে সেতারের একটা চমৎকার প্রয়োগ ছিল। সেতারটা যিনি বাজিয়েছিলেন, তাঁর নাম জয়রাম আচার্য। সলিল চৌধুরী একজায়গায় বলছেন, জয়রাম আচার্য এমন একজন সেতারবাদক ছিলেন যিনি সেতারের স্ট্রিং সিলেকশন ও রেকর্ডিং-এ মাইক্রোফোন প্লেসমেন্টের একজন মাস্টার, কিন্তু দিনের শেষে ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’-র শেষ কথা লতার ভোকালাইজিং।

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ] কবি, গীতিকার, সুরকার, গল্পকার ও সঙ্গীত পরিচালক

 

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই দশটা গানের মধ্যে লতাজি সলিল চৌধুরীর ওই একটাই গান রেখেছেন, কিন্তু সলিল-লতা জুটির আরও বেশি জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ গান ‘মধুমতী’ (১৯৫৮) সিনেমার ‘আ যা রে পরদেশি’-কে রাখেননি। কেন রাখলেন না? আমরা শ্রোতারা এই প্রশ্ন তুললেও সেটা ছিল সম্পূর্ণভাবে লতাজির সিদ্ধান্ত, তিনি ‘আ যা রে পরদেশি’কে কেন সেই তালিকায় রাখেননি, তা তিনিই বলতে পারতেন। যদিও একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পরবর্তীতে হিন্দি গানের যেকোনও অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসে লতা মঙ্গেশকরকে একবার না একবার ‘আ যা রে পরদেশি’ গাইবার অনুরোধ আসতই, এবং লতাজি সে গান গাইতেনও। একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এই বিশেষ গানটি লতাজিকে তাঁর দীর্ঘ কেরিয়ারে যতবার গাইতে হয়েছে, ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’ ততবার গাইতে হয়নি।

এই ‘আ যা রে পরদেশি’ গানটিরও একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আগেই বলেছি, ‘আ যা রে পরদেশি’ ১৯৫৮ সালের ‘মধুমতী’ ছবির গান। গানটির সুর তারও আগে রাজ কাপুর পরিচালিত ‘জাগতে রহো’ (১৯৫৬) ছবির আবহসঙ্গীত থেকে তৈরি করা। ‘জাগতে রহো’-র সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ‘আ যা পরদেশি’ নানা দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এর আগে পর্যন্ত ফিল্মফেয়ার পুরস্কার গানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সঙ্গীত পরিচালকদেরই দেওয়া হত, গায়ক-গায়িকা অর্থাৎ প্লেব্যাক সিঙ্গারদের ফিল্মফেয়ারের জন্য বিবেচনা করা হত না। পুরস্কারের যা নিয়ম, আগের বছরের অবদানের জন্য পরের বছর পুরস্কার দেওয়া হত। অর্থাৎ ৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া যাবতীয় চলচ্চিত্র বিবেচনা করে ১৯৫৭ সালের ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ঘোষণা করা হত।

এবার ১৯৫৬ সালের ‘চোরি চোরি’ ফিল্ম-এ সঙ্গীতের জন্য শঙ্কর-জয়কিষন জুটি ১৯৫৭ সালের ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর পেলেন। তখন ফিল্মফেয়ারে একটা নিয়ম ছিল, পুরস্কার-প্রদান অনুষ্ঠানের দিন যে সঙ্গীত পরিচালক পুরস্কার পাচ্ছেন, তাঁর সিনেমার গান গায়ক বা গায়িকাকে মঞ্চে পারফর্ম করতে হত। এই নিয়ম মেনে ১৯৫৬ সালের কাজের জন্য প্রদেয় পুরষ্কারের মঞ্চে লতাজিকে ‘চোরি চোরি’ ছবি থেকে ‘রসিক বালমা’ গাইতে বলা হল। লতাজি পত্রপাঠ তা প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। তাঁর অকাট্য যুক্তি— পুরস্কার পেয়েছেন সঙ্গীত পরিচালক, গায়িকা তো পাননি, তাহলে তিনি পুরস্কারপ্রদান মঞ্চে গান গাইবেন কেন? যিনি পুরস্কারটি পেয়েছেন তিনিই না হয় গানটা গেয়ে দিন।

ফিল্ম-ফেয়ারে তো গায়ক-গায়িকাদের অবদানের ন্যূনতম স্বীকৃতি নেই। জয়কিষনজির সঙ্গে লতাজির খুব ভালো হৃদ্যতা ছিল, কিন্তু তিনিও লতাজিকে মঞ্চে গান গাওয়াতে ব্যর্থ হলেন। যাই হোক, শঙ্করজি অনেক সাধ্য-সাধনা করে শেষমেশ লতাজিকে পুরস্কারমঞ্চে ‘রসিক বালমা‘ গাওয়াতে পারেন। তবে লতা মঙ্গেশকরের প্রকাশ্য প্রতিবাদে চলচ্চিত্র মহলে হইচই পড়ে গেল। এই ঘটনায় ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে যে তারা এতদিন ধরে কী কেলেঙ্কারিটাই না করে আসছেন। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে ‘মধুমতী’ ফিল্মে ‘আ যা রে পরদেশি’ গানের জন্য প্রথমবার সেরা গায়কের পুরষ্কার ঘোষণা করা হল এবং ১৯৫৯ সালের অনুষ্ঠানে তা পেলেন লতা মঙ্গেশকর।

অর্থাৎ লতা মঙ্গেশকরের প্রতিবাদ সঙ্গীতের যোগ্য সম্মান আদায় করে নিতে একটা বিশিষ্ট ভূমিকা নিল। পরের বছর সেরা গায়কের পুরস্কার পেলেন মুকেশ, ‘আনাড়ী’ ছবিতে ‘সবকুছ শিখা হামনে না শিখি হোঁশিয়ারি’ গানের জন্য। যদিও, পুরুষকণ্ঠ ও মহিলাকণ্ঠের সেরা প্লেব্যাক গায়ক-গায়িকার জন্য আলাদা আলাদা পুরস্কার চালু হতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছিল, কিন্তু সংস্কারের শুরুটা করে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরই।

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ] কবি, গীতিকার, সুরকার, গল্পকার ও সঙ্গীত পরিচালক

প্রসঙ্গত, সলিল চৌধুরীর জীবনের প্রথম ও শেষ ফিল্মফেয়ার এই ‘মধুমতী’-র জন্য। যদিও এর পরেও নানা ছবিতে এর চেয়েও অসাধারণ সব সুরসৃষ্টি করেছিলেন সলিলদা, কিন্তু ফিল্মফেয়ার তাঁকে আর যোগ্য বলে বিবেচনা করেনি, যদিও অনেক তুলনামূলকভাবে সাধারণ সুরকার সে পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের দেশে পুরস্কারপ্রদান প্রক্রিয়াটা এরকমই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা প্রহসন। সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। যেটা বলার তা হল ‘আ যা রে পরদেশি’ এই গানটা সাউন্ডট্র‍্যাক থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন পরিচালক বিমল রায়, লতাজির জোরাজুরিতেই শেষমেশ গানটাকে রেখে দেন, সেই গানটাই ভারতবর্ষে সঙ্গীতে চিরকালীন ইতিহাস সৃষ্টি করল।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার, অনেক ওয়াকিবহাল শ্রোতারও এই গানটি নিয়ে একটা ভুল ধারণা আছে। অনেকেই ভাবেন, এই গানে ইংলিশ ফ্লুটের যে অনবদ্য ব্যবহার আছে, তা মনোহারী সিং-এর। কিন্তু তা সম্ভব নয়, মনোহারী সিং তখনও ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দেননি৷ ‘আ যা রে পরদেশি’ গানে যিনি ইংলিশ ফ্লুট বাজিয়েছিলেন, তাঁর নাম সুমন্ত রাজ। এছাড়াও এই গানে আরেকজন শিল্পীও বাঁশি বাজিয়ে সঙ্গত করেছিলেন, তাঁর নাম ত্রিভুবন।

এরপরে আমরা আরেকটা হিন্দি ফিল্মের গানের কথা বলব, ফিল্ম ‘মায়া’ (১৯৬১)। ১৯৬০ সালে লতাজির গাওয়া বাংলা গান ‘ওগো আর কিছু তো নাই‘, এর হিন্দি হয়েছিল এই ‘মায়া’ ছবিতে। গানটির হিন্দি সংস্করণ ‘তসবির তেরি দিল মে’। এটা ছিল মহম্মদ রফি ও লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েট। কিন্তু কোনও কারণে, হয়তো সলিল চৌধুরীর গান এর আগে তেমনভাবে না গাওয়ার কারণে, একটি জায়গায় গানের স্পিরিটটা ধরতে মহম্মদ রফির একটু সমস্যা হচ্ছিল। ফলে বারবার রেকর্ডিং বাতিল হচ্ছিল।

একটা সময় লতাজি সলিল চৌধুরীকে সাজেশন দিয়েছিলেন, ‘সলিলদা, এত যখন সমস্যা হচ্ছে, আজ বরং রেকর্ডিং বন্ধ থাক।’ কিন্তু সলিল চৌধুরী শেষমেশ বারোতম টেকে গানটির রেকর্ডিং ওকে করেন। ওই সিনেমাতে আরেকটা গান ছিল— ‘অ্যায় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল’। পরে গানটির বাংলা হয়, ১৯৬৩ সালের পুজোর গান হিসেবে সে গান গাইলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়— ‘একদিন ফিরে যাব চলে’। সে গানও সুপারহিট।

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ]

‘মায়া’-তে ‘অ্যায় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল’ গানের আবার দুটো ভার্সন ছিল। একটা লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে সোলো, আরেকবার দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের লতাজির সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ছিল। কিন্তু এই ডুয়েট গানটায় লতাজি কণ্ঠ দিয়েছেন বটে, কিন্তু কোনও লিরিক গাননি। গানের কথা সবটাই গেয়েছেন দ্বিজেনবাবু, লতাজির কণ্ঠকে সলিল চৌধুরী ব্যবহার করেছিলেন গানের মাঝখানে হারমোনাইজেশনের জন্য। যেসব জায়গায় লতাজির কণ্ঠ ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে সাধারণত কোনও মানুষের গলা পৌঁছয় না।

সলিল চৌধুরী এই গানে লতাজি গলা নিয়ে যা যা করিয়েছেন, তা সত্যি অন্য কোনও মানুষের পক্ষে করা সম্ভব হত বলে মনে হয় না। এই গানের পরে লতাজি মজা করে সলিলদাকে বলেছিলেন, “সলিলদা, মিউজিকের বদলে আপনি আমার গলা ব্যবহার করে নিলেন। এরপর মিউজিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারশিপটা আমাকে দিন তাহলে!”

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ]

এরপরের যে গানটার কথা সেটা হল ‘আনন্দ’ (১৯৭১) ছবির গান— ‘না জিয়া লাগে না’। এই গান আগেই বাংলা হয়েছে, লতাজি গেয়েছেন ‘না মন লাগে না’। দুটো গানেরই সঞ্চারিতে লতাজির যে অসামান্য ইম্প্রোভাইজেশন, (‘চোখে চোখ চেয়ে থাকা ভালোওওওও লাগে না’/ ‘পিয়া তেরি বাওরি পে রহাআআআ যায়ে না’) তা গানদুটিকেই অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। সলিল চৌধুরী লতা মঙ্গেশকরের এইসব নিজস্ব ইম্প্রোভাইজেশনে কোনওদিনও বাধা দেননি। এইসব ইম্প্রোভাইজেশনের কী সব চমৎকার ফলাফল হয়েছিল তা আমরা সবাই দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি।

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ]

আরেকটা ছবির কথা বলতেই হয়। ‘রজনীগন্ধা’ (১৯৭৪) ছবির টাইটেল সং ছিল লতাজির গাওয়া ‘রজনীগন্ধা ফুল তুমহারে’। ছবিতে আরেকটা গান ছিল মুকেশের গাওয়া ‘কইবার ইঁয়ুহি দেখা হ্যায়, ইয়ে যো মনকি সীমারেখা হ্যায়‘। এই গানের জন্য মুকেশ জীবনের প্রথম ও শেষ ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। মজাটা হল, এই দুটো গানই লতাজির গাইবার কথা ছিল। কিন্তু ‘রজনীগন্ধা’ খুব কম বাজেটের ছবি ছিল, লতাজিকে দিয়ে টাইটেল সং গাওয়ানোর পরে অন্য কোনও গান গাওয়ানোর মতো বাজেট প্রযোজকের ছিল না।

এমনিতেই লতাজি এই ছবিতে কম বাজেটেই গান করেছেন সেটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। কিন্তু তাঁকে দিয়ে দুটো গান গাওয়ানো সম্ভব ছিল না। আর দ্বিতীয় গানটি যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ডের গান, থিম গান, কারও লিপে ছিল না, তাই মহিলা কণ্ঠের বদলে গানটি পুরুষকণ্ঠে হলে কোনও ক্ষতিও ছিল না। সে কারণেই সলিল চৌধুরী মুকেশকে দিয়ে গানটি গাওয়ালেন এবং এই গানের সুবাদেই মুকশের তাঁর সঙ্গীতজীবনের একমাত্র জাতীয় পুরস্কারটি জিতে নিলেন।

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ] কবি, গীতিকার, সুরকার, গল্পকার ও সঙ্গীত পরিচালক

সলিল চৌধুরী এই প্রসঙ্গে একটা কথা বারবার বলতেন, “সবাই যে গান গাইতে পারবে, আমি লতাকে সে গান কেন দেব? যেটা অন্য কেউ পারবে না, আমি সেইরকম গান লতাকে দেব।” সলিল চৌধুরী একথাও বলেছেন যে সবাই ওঁকে বলতেন, সলিলদা গানের এই জায়গাটা কঠিন লাগছে, এটা একটু সোজা করে দেবেন? কিন্তু লতা মঙ্গেশকরই একমাত্র শিল্পী যিনি এই কথাটা কোনওদিন সলিল চৌধুরীকে বলেননি। যত কঠিন গান সলিল চৌধুরী লতা মঙ্গেশকরকে দিন না কেন, তিনি ঠিকই গেয়ে দিতেন।

উনি বারবার বলেছেন, “শুধুমাত্র লতার প্রতিভার ক্ষেত্রে একটা কথাই প্রযোজ্য— Sky is the limit.” একবার এক বন্ধুস্থানীয় সাংবাদিক-লেখককে সলিল চৌধুরী নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন, “Take the game of football, all the rules are there… free kick, throw-in, off-side, penalty… yet there is a player like Pele, who produces something outside the rules, even while being within them. I am that Pele in music.” নিজের সম্বন্ধে এত বড় একটা কথা বলছেন সলিল চৌধুরী। উত্তরে সেই বন্ধুস্থানীয় সাংবাদিক বলছেন, “Yes, Salil, you are that Pele, but only when you have Lata Mangeshkar in goal to test your striking artistry.”

 

সলিল চৌধুরী [ Salil Chowdhury ]

এরপরে আমাদের আর কিছু বলবার থাকে না। বাকিটা ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাক। যতদিন ভারতীয় ফিল্ম ও আধুনিক গান বেঁচে থাকবে, সলিল চৌধুরী ও লতা মঙ্গেশকরকে কোনওদিন ভোলা যাবে না। লতা-সলিল জুটির আরও অনেক বিখ্যাত গান বাকি রয়ে গেল যা নিয়ে অনেক আকর্ষণীয় ঘটনা আছে। কিন্তু ভালো জিনিসকেও তো কোথাও একটা থামতেই হয়। যেমন থামতে হল লতা মঙ্গেশকরকেও।

লতাজির প্রয়াণের পর গুলজার একটা দামি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় সঙ্গীতে গত একশো বছর হল আসলে লতা মঙ্গেশকরেরই শতাব্দী। ফেলে আসা শতককে এক কথায় এর চেয়ে ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। গুলজারসাবের এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের প্রতি আমরা আরও একবার প্রণত হই, তাঁকে আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাই। লতা মঙ্গেশকর আর নেই, কিন্তু তাঁর গান আমাদের অনন্য সম্পদ হয়ে রয়ে গেল।

 

 

আরও দেখুনঃ

 

Exit mobile version