সঙ্গীত মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের মতো সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে সঙ্গীত শুধু বিনোদনের উপকরণ নয়; এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা, সংগ্রাম ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে গবেষণা ও প্রবন্ধ রচনার প্রয়োজনীয়তা বহু আগেই অনুভূত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সঙ্গীত গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা তুলনামূলকভাবে দেরিতে হলেও এদেশের লোকসঙ্গীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও আধুনিক ধারার সঙ্গীত নিয়ে যে ঐতিহাসিক চর্চা গড়ে উঠেছে তা আজ একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করেছে।
Table of Contents
বাংলাদেশে সঙ্গীত গবেষণা
প্রারম্ভিক ধাপ: লোকজ ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে গবেষণা
বাংলাদেশের সঙ্গীত গবেষণার প্রথম ধাপ শুরু হয় মূলত লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে। বাংলার মাটি ও মানুষের জীবনসংগ্রাম, কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান—সবকিছুই ফুটে উঠেছে বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, জারি–সারি, পালাগান, গাজীর গান ইত্যাদি ধারায়।
- উনিশ শতকের শেষ ভাগে ও বিশ শতকের শুরুতে ব্রাহ্মসমাজ ও নবজাগরণ আন্দোলনের প্রভাবে কিছু সাহিত্যিক ও সংগীতপ্রেমী লোকসঙ্গীতকে সংরক্ষণে মনোযোগী হন।
- দীনেশচন্দ্র সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ সাহিত্যিকেরা বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রতি আলোকপাত করেন, যার ধারাবাহিকতায় গান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের সূচনা ঘটে।
- পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও বাউল ও লোকগানের প্রতি গভীর আকর্ষণ দেখান এবং তাঁর অনেক গানে লোকসুরের ব্যবহার করেন। এর ফলে লোকগান গবেষণা একটি নতুন গতি পায়।
পাকিস্তান আমলে গবেষণার চ্যালেঞ্জ
রাষ্ট্রীয় নীতি ও সাংস্কৃতিক দমন
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হলে সাংস্কৃতিক গবেষণার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ ও আরোপিত পরিচয় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে “এক ভাষা, এক সংস্কৃতি”-র ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এর ফলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং উর্দুকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা চলে। এই পরিবেশে বাংলা ভাষা ও বাংলার নিজস্ব সংগীতকে দ্বিতীয় সারিতে ঠেলে দেওয়া হয়।
সঙ্গীত গবেষণায় সীমাবদ্ধতা
বাংলার সঙ্গীত গবেষণাকে তখন অনেকাংশেই লোকসংগীতের প্রাচীন ধারা সংরক্ষণে সীমিত করে রাখা হয়েছিল। বিশেষত, শাস্ত্রীয় সংগীত বা আধুনিক সংগীত নিয়ে গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা খুবই কম ছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনীহা থাকায় অনেক গবেষককে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে।
প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক চর্চা
তবুও প্রতিরোধ থেমে থাকেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ এসময়ে গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানকার শিক্ষক ও গবেষকরা লোকসংগীত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে মনোযোগী হন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আঞ্চলিক গানের উপর কাজ শুরু করেন।
সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন ছায়ানট, সঙ্গীতভবন ইত্যাদিও লোকসংগীতকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে।
লোকগান সংগ্রহ ও নোটেশন
এ সময়কার অন্যতম বড় কাজ ছিল লোকগান সংগ্রহ ও নোটেশন তৈরি। বিশেষ করে বাউল গান সংগ্রহে এক ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে। গবেষকরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে গান লিখে রাখতেন, নোটেশন বানাতেন এবং কিছু গান রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। এর ফলে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বহু পুরনো গান রক্ষা পায়।
বাউল ও আধ্যাত্মিক সংগীত
বাউল ও মুর্শিদি সংগীতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব না দিলেও, কিছু গবেষক এই ধারার আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক মূল্য অনুধাবন করেছিলেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় বাউল গানকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়।
সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রভাব
যদিও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক গবেষণাকে সীমিত করে রাখতে চেয়েছিল, তবে এ সময়ের সংগৃহীত তথ্য ও গবেষণা পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গীত গবেষণার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এই প্রতিরোধই পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সঙ্গীত গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর নতুন দিগন্ত
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সঙ্গীত গবেষণায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে গান ছিল প্রেরণার অন্যতম উৎস, তাই রাষ্ট্রীয়ভাবেই সংগীতকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়।
- স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ বেতার ও শিল্পকলা একাডেমি বিভিন্ন লোকগান সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচারের উদ্যোগ নেয়।
- বাংলা একাডেমি সঙ্গীত নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে; লোকগীতি ও আঞ্চলিক গানের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ শুরু হয়।
- একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষকরা সংগীতকে নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে শুরু করেন।
সঙ্গীত গবেষণার প্রধান ক্ষেত্রসমূহ
১. লোকসঙ্গীত গবেষণা
বাংলাদেশের লোকগানের ভাণ্ডার বিশাল। বিশেষত বাউল, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে।
- শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আলী, আব্দুল আলিমের গানসংগ্রহ ইত্যাদি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি শত শত লোকগান সংগ্রহ করে বই আকারে প্রকাশ করেছে।
২. রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি গবেষণা
- রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে গবেষণা শুরু হয় তাঁর জীবদ্দশাতেই। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জাতীয় ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে লালন করা হয়েছে।
- নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলগীতি সংরক্ষণ ও গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
৩. শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গবেষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা শুরু হয়।
- রাগ-রাগিনী, তাল ও ঘরানাভিত্তিক গবেষণা এই ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে।
- উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, উস্তাদ আয়েত আলী খান প্রমুখ গুরুজনের অবদান নিয়েও গবেষণা হয়েছে।
৪. আধুনিক গান ও চলচ্চিত্র সঙ্গীত গবেষণা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র সঙ্গীতও গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
- গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলম খান, আলাউদ্দিন আলী প্রমুখ সুরকারদের অবদান এখন বিশ্লেষণের অংশ।
- আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি গবেষণা হচ্ছে গান কীভাবে সমাজ ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ
১. বাংলা একাডেমি – লোকগীতি ও আঞ্চলিক সঙ্গীত সংগ্রহ ও গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা।
২. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি – সঙ্গীত গবেষণা, সংরক্ষণ ও অনুষ্ঠান আয়োজন।
৩. নজরুল ইনস্টিটিউট – কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে গবেষণার প্রধান কেন্দ্র।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় – সঙ্গীত বিভাগে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা।
5. ইনডিপেনডেন্ট রিসার্চার ও বেসরকারি সংগঠন – যেমন বাউল গবেষণা কেন্দ্র, লোকসঙ্গীত আর্কাইভ ইত্যাদি।
সমকালীন গবেষণার ধারা
বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গীত গবেষণা অনেকটাই বহুমাত্রিক।
- ডিজিটাল আর্কাইভিং: পুরনো গান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
- সঙ্গীত ও সমাজ: গান কীভাবে রাজনীতি, ধর্ম ও সামাজিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করে—সে বিষয়ে গবেষণা বাড়ছে।
- মিউজিকোলজি: সংগীততত্ত্ব, সাইকোলজি ও প্রযুক্তির সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে।
- গ্লোবাল কানেকশন: প্রবাসী গবেষকরা বাংলাদেশি সঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করছেন।
চ্যালেঞ্জ
- পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব।
- লোকগানের প্রাচীন নথি ও রেকর্ডিং অনেকক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
- সঙ্গীত গবেষণাকে একাডেমিক ক্ষেত্রের বাইরে ‘শখের বিষয়’ হিসেবে দেখা।
- তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গবেষণার আগ্রহ তৈরি করার সীমাবদ্ধতা।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সঙ্গীত গবেষণার ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল।
- ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে গান সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ সহজ হয়েছে।
- আন্তর্জাতিক গবেষণার সঙ্গে বাংলাদেশের গবেষকরা যুক্ত হচ্ছেন।
- রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাড়লে বাংলাদেশের সঙ্গীত গবেষণা বিশ্ব অঙ্গনে আরও প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশে সঙ্গীত গবেষণা শুরু হয়েছিল লোকগানকে ঘিরে। ধীরে ধীরে এর বিস্তার হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আধুনিক গান এবং চলচ্চিত্র সঙ্গীতে। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা এখনও সীমিত হলেও, নানা উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এর বিস্তার ঘটছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সঙ্গীত গবেষণা কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।