বাংলা গানের বিবর্তনে বাউল গানের অবস্থান নিয়ে আজকের আলোচনা। বাউল গান বাংলাগানের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় একটি যুগোপযোগী অধ্যায়। বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি অবকাঠামো বাউল পর্যায়ের গান। লঘুপ্রকৃতির সঙ্গীত হলেও এ গানের ব্যাপ্তি সুদুর প্রসারী। প্রকৃতির অকৃপণ শ্যামালিমার মধ্যে হতে বেড়ে ওঠার মানব-মানবীর মনের কথা, বিরহ, আরেক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের ধারায় রচিত বাউল পর্যায়ের গান, ভাই আঞ্চলিকতার প্রশ্নে বাউল গান আজও বিবর্তিত। নানা ধরনের রচনায় সুরবিন্যাসে, সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্যে শব্দচয়ন এবং বাক্য সমন্বয়ের স্বাভাবিক অবস্থানে বাংলার জন-মানষে একটি স্থান দখল করে নিয়েছে বাউল গান। শিল্পীর আধ্যাত্মিক ভাবনা উপস্থাপিত বাউল গানের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ পর্যায়ে আমি লঘুসঙ্গীত হিসাবে বাউল গানের গতিপ্রকৃতি বর্ণিত করবার চেষ্টা করেছি মাত্র।
বাংলা গানের বিবর্তনে বাউল গানের অবস্থান
প্রকৃতির অকৃপণ শ্যামালিমার মধ্য হতে বেড়ে ওঠা মানব-মানবীর মনের কথা ও ভাবরস মিশ্রণে রচিত গীতিরীতিকে বাউল গান বলে, যা অনেক ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক এবং পরিবেশনায় পোষাকীয় ঐতিহ্য বিদ্যমান ।
বাউল শব্দের উৎপত্তি:
বাংলায় বাউল শব্দটি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। কারও মতে, বায়ু শব্দের সাথে, এই অর্থদ্যোতক ‘ল’ প্রত্যয় যোগ করে বাউল শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সংস্কৃত বাতুল শব্দ হতে বাউল কথার উৎপত্তি। বাতুল কথার অর্থ পাগল। ইষ্টের জন্য ব্যাকুল এই অর্থে অনেকে ব্যাকুল থেকে বাউল এসেছে বলে মনে করেন।
বাউল গানের উন্মেষ ও বিকাশ:
মোটামুটিভাবে বলা যায় সতের শতকের দ্বিতীয় পাদ (১৬৫০ খ্রিঃ) থেকেই বাউল মতের উন্মেষ। মাধববিবি ও আউয়াল চাঁদই এই মতের প্রবর্তক বলে সুধীজনের ধারণা। মাধব বিবির শিষ্য নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্রই বাউল মত জনপ্রিয় করেন। আর ঊনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই বাউল গান পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) যিনি ফিকির চাঁদ নামেই সমধিক পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে বাউল মতবাদের উদ্ভব মধ্যযুগে হলেও কাল নির্ণয় প্রশ্নে পণ্ডিতমহলের যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রনাথ ভট্টচার্যের মতে, ১৬২৫ থেকে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাউল ধর্ম পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করে। বিভিন্ন ধর্ম সমন্বয়ে যেমন বৌদ্ধ সহজিয়া, ইসলামী সুফিবাদ প্রভৃতি মতের উপর ভিত্তি করে বাউল ধর্মের ভিত্তি প্রস্তর সাধিত হয়েছে। এই সাধনা মার্গের আদি ধারক ও বাহক মুসলমান ফকির ও পীর পয়গম্বর বাদীরা।
বাউল গানের বৈশিষ্ট্য:
এছাড়া লালন পরবর্তী গান, দুদ্দুশা, পাগলাকানাই, রাধা রমন, মদন, শানুর, সাহাবুদ্দীন, হাছন রাজা অসংখ্য মরমিয়া সাধকদের মধ্যদিয়ে বাউল গান নানা তরঙ্গ ঢঙে বয়ে চলছে।
বাংলাগানের প্রকরণে বাউল গানে নিম্নখিলিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়:
(১) বাউলগানের যে রূপটির সাথে আমরা বর্তমানে পরিচিত তা অনেকটা সংশোধিত এবং অভিজাত । মনে হয় বাউলগান বাংলা সঙ্গীতের একটি নতুন প্রকরণ যা কোনো পেশাগত বা ভাবনাগত সূত্রপাতে পরবর্তীকালে জন্মলাভ করেছে।
(২) বাংলাদেশে প্রচলিত লোকসঙ্গীতের বহুবিধ প্রকরণ রয়েছে। বেশির ভাগ প্রকরণের মধ্যে লোকানুবৃত্তির বিশেষ সন্ধান পাওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে ঐসব গানে নানা ধরনের সংকলনও থাকে। কিন্তু বাউল গান কেবলমাত্র একই ধারায় বৃত্তিহীন মানুষেরই ভাবপ্রবণ অন্তপ্রকাশ।
(৩) বাউলের ধর্ম প্রচারের উপর বৈষ্ণবীয় ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। তাতে মনে হয় বাউ সপ্তদশ শতকের অনেক পরের কোনো এক ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র।
(৪) বাউল গানের রূপগত বৈশিষ্ট্য বিচার করলে প্রাচীন পর্যায়ে বাংলা সঙ্গীতে স্বর সংকলনের যে বিধি বা গ্রাম প্রয়োগের রেয়াজ ছিল তার প্রয়োগ দেখা যায়।
(৫) বাউল গান উচ্চ গ্রামে গাইতে হয়। এটি কেবলমাত্র বাংলাগানেই লক্ষণীয়। তাই রূপগত বৈশিষ্ট্য বিচার করলে বাউল গানকে বাংলার প্রাচীন সঙ্গীত বলা যায়।
(৬) বাউল গান কেবলমাত্র ভাবনার প্রকাশ নয়। এর মধ্যে সাঙ্গীতিক ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার পূর্ণায়তরূপ প্রকাশ পায়।
(৭) বাউল গান কোনো পেশাগত সূত্রে জন্মলাভ করেনি। তবে গান গাওয়াই বাউলের পেশা তাই সঙ্গীতকে জীবিকার একটি অঙ্গ হিসাবেই বাউল সম্প্রদায় গ্রহণ করেছে।
(৮) ভরত যেখানে লোক বৃত্তানুকরণের কথা বলেছেন, সেই বৃত্তির মধ্যে একদিকে যেমন ক্রিয়াগত বৃত্তি আছে অন্যদিকে তেমনি ভাগবতবৃত্তির গুরত্বও আছে। বাউল সঙ্গীতের মধ্যে ক্রিয়াগত বৃত্তির প্রভাব কম। কেবলমাত্র ভাবগত মানসিকতাই বাউলের অস্তিত্ব রক্ষা করে। তাই ভাবগত বৃত্তির প্রতিফলন বাউলগানের প্রতোস্তরেই আছে।
(৯) বাউলেরা বৃত্তিহীন নয়। তাদের মৌলিক বৃত্তি হলো গুরুতে নিষ্ঠা, গুরুতে সেবা, এবং সার্বিকভাবে গোষ্ঠীতে যৌথ-জীবনজীবিকার মাধ্যমে ভগবদ-উন্মুখ বৃত্তি গ্রহণের চেষ্টা। এই বৃত্তির মধ্যে লাভ ক্ষতি, কেনাবেচা, ভাঙাগড়া ইত্যাদি বিষয়গত অনুভূতির প্রয়োগ না থাকলেও এর মধ্যে আছে ত্যাগবৃত্তি, সেবাবৃত্তি, সত্যনিষ্ঠা, জ্ঞানবৃত্তির অপূর্ব সমন্বয়। তাই বাউল গানের প্রতিটি কথাই হলো এই বৃত্তিরই পূর্ণপ্রকাশ।
(১০) আপাত বিচারে বাউল সম্প্রদায়কে বৈষ্ণবানুগ সম্প্রদায় বলে গ্রহণ করতে বিশেষ আপত্তি থাকে না কিন্তু বিচারে আউল এবং বাউল এই দুটি সম্প্রদায়ই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মের বহুপূর্ব হতেই বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। তরজার প্রহেলিকায় অদ্বৈতাচার্য বলেছেন
“বাউলকে কহিও লোকে হইল আউল
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল”
বাউল সম্প্রদায়ের অনেক সিদ্ধান্ত, আচরণ, সংস্কার শ্রী চৈতন্যদেব এবং তাঁর অনুগত ভক্তদের প্রভাবে অনেকটা সংশোধিত হয়েছে। এজন্য প্রাক-চৈতন্য যুগের বাউল এবং চৈতন্যযুগের বাউলের মধ্যে তফাত রয়েছে। বাউলগানের মধ্যে চৈতন্যের স্মৃতি রূপ প্রসঙ্গ এমন কি সময় ধর্মপ্রচারের পন্থা বিষয়ক গানও সৃষ্টি হয়েছে। যেমন :
“গৌর রূপ দেখিয়া হইয়াছি পাগল
ঔষধে আর মানে না
চল সজনী যাইগো নদীয়ায় ।।”
(১২) চৈতন্য-উত্তর যুগে যে বাউল সম্প্রদায় সৃষ্টি হয় তার উপর চৈতন্যের প্রভাব যথেষ্টই ছিল। পরবর্তীতে কালের বিবর্তনের তা আরো পরিপূর্ণতা পায়।
সমাজ জীবনে বাউল গান:
সমাজ জীবনে বাউলদের প্রভাব কম নয়। এক কথায় বাংলার প্রাত্যহিক জীবনধারা ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিচিত্র নৃত্য, গীতি ও বাদ্য তথা আনন্দানুষ্ঠানের সঙ্গে। প্রাচীন চর্যাগীতিতে যেমন এর নিদর্শন লক্ষ করা যায়, তেমনি সামাজিক ব্রতোৎসব ছড়ার আকারে সহজ-সরল গান এ ছন্দায়িত নৃত্য। ঝুমুর গান, ভাটিয়ালী, গম্ভীরা, জারি-সারি, বাউল গানে বাংলার স্বাচ্ছন্দ সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়ে উঠেছে।
চর্যাপদ ও বাউল গান:
বাউলগানের পূর্বরূপ চর্যাগান এরূপ মনে করা অসঙ্গত নয়। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ চর্যা রচনা করতেন এবং তা গেয়ে বেড়াতেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে। চর্যাপদ রচনা ও বাউল রচনার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ভাবের দিক থেকে দুটি একই প্রকৃতির। অধ্যাপক আহমেদ শরীফের মতে, “বাংলায় পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই মধ্যযুগে সুফী প্রভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মতরূপে প্রসার লাভ করে। এভাবে চর্যাপদের পরিণতি ঘটে বাউল গানে ও সহজিয়া পদে।” এ ছাড়াও চর্যাপদ ও বাউল গানের মধ্যে সাঙ্গীতিক অবকাঠামোর বিশেষ মিল লক্ষ করা যায়।
বাউল গানের ভাষা:
বাউলগানের ভাষার মধ্যে মেযন লৌকিক ভাষার প্রভাব আছে তেমনি আবার আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবও যথেষ্ট দেখা যায়। মূলত বাউল ভাষা, লোক ভাষা, কিন্তু ভাষার গ্রন্থনার মধ্যে যে কাব্যিক ছন্দের প্রভাব লক্ষ করা যায় তাতে বাউল গানের ভাষাকে অভিজাত না বলে উপায় নেই।
বাউল গানে ব্যবহৃত রাগ প্রসঙ্গ:
বাউলগানকে মূলত বাংলার প্রাচীন সঙ্গীতের প্রকরণ চলা যেতে পারে। বাউলগানে সুরের মধ্যে যে ভৈবরী এবং বিভাসের প্রভাব দেখা যায় তা মূলত বাংলারই সুর। এছাড়ও ঝিঁঝিট খাম্বাজ, এমন কি কাফীর কিছু কিছু প্রয়োগ দেখা যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো রাগ প্রয়োগ কোনোক্রমেই হিন্দুস্থানী প্রকরণের অনুগামী নয়। যেমন ভীমপলশ্রী; বাউলে দুটি গান্ধার ও দুটি নিষাদেয় প্রয়োগ বিভাসে শুদ্ধ রে, খাম্বাজে উভয় নিখাদ ইত্যাদি। খাম্বাজ ঠাটে দেশ রাগে বেহাগের ছোঁয়া কোনো কোনো গানে দেখা যায়। অতএব বাউল গানে যে রাগের প্রয়োগ রয়েছে তা প্রমাণিক।
বাউল গানে ব্যবহৃত তাল:
বাউলগানে যে-সকল তালের প্রয়োগ দেখা যায় সেগুলো মূলত ছন্দ। তার মধ্যে অভিজাত শ্রেণীর তালের কোনো প্রয়োগ নেই। সাধারণত খেমটা, আড়াটো, দাদরা, কার্ফা, ছক্কি ইত্যাদি তালের আশ্রয়েই গানগুলো গাওয়া হয়ে থাকে। খেমটা একটু বড় করে টেনে গাইলে তাকে গড়খেমটা বলে। আবার টানা প্রকরণের মাত্রাগুলি একটু আড়া গতিসম্পন্ন হলে তাকে আড়াখেমটা বলে। অর্থাৎ তালের মূলনীতিগুলির প্রভাব পাওয়া গেলেও কোনো সমৃদ্ধতালের রূপ বাউলগানে পাওয়া যায় না।
বাউল গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র:
বাউলগানে যে সকল বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় সেগুলি সুপ্রাচীন এবং গ্রামীণ উপকরণে তৈরি। এ গুলোর মধ্যে আছে খমক, দোতারা, একতারা, ডুগি, ঢোলক, গাবতৰাত্তৰ ইত্যাদি।
বাউল গানে বৈষ্ণবী ধারা:
বাউলগানের মধ্যে যে উদাসী বৈরাগ্যনীতি তার সঙ্গে বৈষ্ণবীয় ভাবধারার কিছুটা মিল পরিলক্ষিত হয়। বাউলগানের মধ্যে মন, শুরু, ভাই প্রভৃতি উপজ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কীর্তন গানের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের পদের সংযোজন লক্ষ করা যায়।
যেমন:
(১) বিশ্বরূপ গোস্বামীর গান এসেছে ব্রজের বাকা কালো সখা।
(২) প্রেমানন্দের রচিত গান মন কি করে বরণ কুলে।
(৩) নরোত্তম দাসের রচিত গান হরি হরি কবে মোর হইবে সেদিন।
(৪) জ্ঞান দাসের গান – আবেগে সঙ্গীর অঙ্গে অঙ্গ হেলাইয়া ।
বাউল সুরের আঞ্চলিকতা:
বাউলগানের ক্ষেত্রে সুর বলে নির্দিষ্ট কোনো অবকাঠামো থাকে না। এই সুর অঞ্চলভেদে আঞ্চলিক পরিবেশ অনুযায়ী গড়ে ওঠে। সুর অনুসারে গানের ছন্দও নির্ধারিত হয়। তাই এক এক অঞ্চলের বাউল গানের সুর এক একরকম। যেমন : রাঢ়বাংলার বাউলগানের সাথে পূর্ব বাঙলার বাউলগানের তফাৎ লক্ষণীয়। মধ্যবাংলার বাউল আবার একটা স্বতন্ত্র ধারা লাভ করেছে।
(ক) নদীয়া অঞ্চলের বাউল গান:
বৃহত্তর নদীয়া অঞ্চলকে বাউল সাধনার তীর্থক্ষেত্র বলা যায়। কারণ নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া হতেই বাউল মতের প্রচার ও প্রসার, বাউল কবিদের জন্য এবং গায়কদের উদ্ভব। প্রসিদ্ধ বাউল সাধক লালন ফকিরের জন্মও এই কুষ্টিয়ার ভাঁড়ারা গ্রামে। দুদ্দুশা, পাগলাকানাই, পাঞ্জুশা প্রভৃতি প্রখ্যাত কবিও গায়ক ঐ অঞ্চলকে ভাবসাধনার কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছিলেন।
(খ) নরসিংদি অঞ্চলের বাউল গান:
এ অঞ্চলটি ছিল বেশ বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। বহু বাউল রচয়িতা গায়কদের বাস ছিল এখানে। এদের মধ্যে মরণচান, ভগাবাউল, সন্তোষ বাউল ও মাখন দাস প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলের গানগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় কৃষ্ণ বিষয়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এগুলি রচিত । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারিন্দা বাজিয়ে এগুলো গাওয়া হয়ে থাকে। সুরের বিস্তারে কীর্তনের ধারা লক্ষণীয়। গানের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দুটি তালের ঝোঁক দেখা যায়। প্রথম অংশে দাদুরা এবং ২য় অংশে কাহারা বাজানো হয়।
যেমন: ওমা যশদে কত বলব আর কানাইব বিবরণ, কানাই গোঠে গোঠে পরাণখুলে
বাঁশি বাজায় অনুক্ষণ।।
(গ) রাজশাহী অঞ্চলের বাউল গান :
রাজশাহী অঞ্চলেও বাউল গানের ব্যাপকতা রয়েছে। এ অঞ্চলের বাউলগানে লক্ষ করলে দেখা যায় গানের মধ্যে একটা কীর্তনীয় ভাবধারা বহমান। বিশেষ করে খোজামত শাহের গান, রাধা রমণের গান প্রভৃতি বাউল পদকর্তা তথা গায়কদের গানের মধ্যে বৈষ্ণবীয় ভাবধারা লক্ষ করা যায়। রাজশাহী। অঞ্চলের বাউলগানের বিষয়বস্তুতে আধ্যাত্মিকতা মূল ঔপজীব্য বিষয় ।
(ঘ) ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাউল গান :
ময়মনসিংহ অঞ্চলের গানকে বলা হয় জালালী ঢঙের গান। এ গান আজও ঘরানার ঐতিহ্য বহন করে আসছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়ে বাউলের একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে আচার-আচরণের দিক দিয়ে মুসলমানী প্রভাব ছিল বেশি। গৈরিক বসন ধারণ চুলদাড়ি রাখা এবং একতারা নিয়ে গান গেয়ে বেড়ানোই এদের পেশা। মুসলমান ফকিরদের মতো এরা ঝাড়ফুক করে এবং গুনীদের মত মাদুলী দান করে। এই অঞ্চলের বাউলদের ঠাকুর বলে অভিহিত করা হয়। এরা মুসলমানের আযান শুনে দাঁড়িয়ে ওঠে। আবার হরিনাম না করে জল খায় না। পরিচয় হিসাবে এরা নামের পেছনে বাবাজী, দাস, খাঁ ইত্যাদি ব্যবহার করে। এ অঞ্চলের গায়কদের মধ্যে গরীব খার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কাঙাল গরীবের একটি পদ –
“শরমে শরম পেলায়ে গেল
রাই-কানু দুটি অনু
যেমন দুধে জলে মিলায়ে গেল ।
(ঙ) নদীয়া জেলার কুমারখালী অঞ্চলের বাউল গান:
ফিকির চাঁদিসুর বাউল সঙ্গীতের মধ্যে একটি বিশিষ্ট সুরের ধারা। এই ধারার প্রবর্তক হরিনাথ মজুমদার। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের অন্তর্গত নদীয়া জেলার কুমারখালী অঞ্চলে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। বাউলের একটি দল গঠন করলে তিনি কাঙাল হরিনাথ আখ্যা প্রাপ্ত হন। পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমার মৈত্র তাঁকে ফিকির চাঁদ নামে ভূষিত করেন। এবং ফিকির চাঁদ নামেই তিনি পরবর্তীতে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে। ফিকির চাঁদী ধারা বহু গানই বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যেমন: “যদি ডাকার মত পারিতাম ডাকিতে”
সর্বশেষে বলা যেতে পারে যে, বাউল গানের মধ্যে বাংলার যে স্বকীয় ভাবধারা ফুটে ওঠে তা বাংলার প্রথম পর্যায়ের সংস্কারমূলক উদ্দীপনা থেকে অর্থাৎ বাঙালি জীবনে যে একটা সাঙ্গীতিক আন্দোলন অন্তরে ধ্বনিত হচ্ছিল তারই সামান্য সুখের ইঙ্গিত বাউল পর্যায়ের গান। তাই বৈচিত্র্য, বৈভবে, ভাষায় সাঙ্গীতিক প্রকরণে এই বাউল গানকে বাংলার প্রাচীন সাঙ্গীতিক রূপ বলে মনে করাটাই অসঙ্গত হবে না।
আরও দেখুনঃ