রাজা মানসিংহ তোমর [ ManSingh Tomar ] : সংগীতজগতে যে সকল মনীষী আত্মত্যাগ এবং অকৃপণ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে চির অমর হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমর (রাজত্বকাল ১৪৮৬-১৫১৬ খ্রি.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজেই ছিলেন সংগীত ও সাহিত্যের এক উচ্চমার্গীয় প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় সংগীতের এক মহা যুগসন্ধিক্ষণে তিনি আবির্ভূত হন।
তোমর বংশীয় রাজন্যবর্গ শুধু রাজ্য শাসন এবং ভোগবিলাসে মগ্ন থাকতেন না বরং শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রতিও তাঁদের প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। ফলে রাজা মানসিংহের মধ্যেও বংশীয় ধারা প্রতিফলিত হয় এবং তিনি নিজেকে সংগীতের উন্নতি ও মান পুনরুদ্ধারে নিবেদিত করেন।
একই সময়ে গুজরাটের সুলতান হুসেন ভারতীয় রাগগুলোকে ইরানি ঢঙে পরিবেশন করছিলেন। ফলে ভারতীয় রাগসংগীতের বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজনে রাজা মানসিংহ ধ্রুপদী গানের ধারা প্রচারে উদ্যোগী হন। তাঁর শুভ প্রচেষ্টায় নিজ রাজদরবারের সংগীতগুণীজন এবং অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ কলাবিদদের সহায়তায় রাগের সংখ্যা, প্রকারভেদ, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা ইত্যাদি সংগ্রহ ও সংকলিত করে মান কুতূহল নামে একটি সংগীতগ্রন্থ সম্পাদনা করা হয়।
শ্রেষ্ঠ বাণীকার কে – এ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মান কুতূহল গ্রন্থে রাজা মানসিংহ লিখেছেন,
‘শ্রেষ্ঠ গায়ক ও গীত রচয়িতার পক্ষে ব্যাকরণ, ছন্দ, অলঙ্কার, রস, ভাব, দেশাচার, লোকাচার সম্বন্ধে উত্তম জ্ঞান থাকা আবশ্যক, তাঁহাকে শব্দশাস্ত্র বিষয়ে প্রজ্ঞান হইতে হইবে। তাঁহার রুচী কলানুবর্তী হইতে হইবে এবং তিনি সময়ের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন। তাঁহার গীত বিচিত্র এবং রমণীয় হওয়া আবশ্যক। প্রাচীন গীতসমূহ তাহার কণ্ঠস্থ থাকিবে এবং তিনি সংগীত, নৃত্য, বাদ্য সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হইবেন।’
এই গ্রন্থে সংগীতজ্ঞ রাজা মানসিংহ তোমর [ ManSingh Tomar ] এর সংগীত ও সাহিত্যপ্রীতির যথেষ্ট পরিচয় মেলে। কেননা সে গ্রন্থে রাগ পরিচয় ছাড়াও তাঁর রচিত উৎকৃষ্ট ধ্রুপদ গানগুলোসহ সংগীতের নানা বিষয়ের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করা হয়েছে।
শাস্ত্রকার সংগীতজ্ঞ ফকির উল্লাহ্ ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করে সঙ্গীতদর্পণ নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। তাঁর সুস্পষ্ট অভিমত থেকে সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব রাজা মানসিংহ তোমরের সংগীত প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন যে –
‘মানসিংহ তোমর সর্বপ্রথম ধ্রুপদ গান রচনা করেন এবং এই চমকপ্রদ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ সংগীতশৈলীর তিনিই স্রষ্টা। তাঁর দরবারে প্রসিদ্ধ সংগীতগুণীদের মধ্যে কর্ণ, চরজু, ধোংডু, বসু, বৈজু, ভগবান, ভানু, মচ্চু, মামুদ ও রামদাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’
সংগীতজ্ঞ এবং উচ্চমার্গীয় সাহিত্যিক ও পদ রচয়িতা রাজা মানসিংহ কর্তৃক ধ্রুপদ গান প্রচারের চেষ্টা সম্পর্কে উল্লেখ করে সংগীত শাস্ত্রকার ফকির উল্লাহ্ তাঁর রাগদর্পণ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘মানসিংহের এই অভিনব প্রচেষ্টার জন্য সংগীতশাস্ত্র বিশেষত গায়নকলা তাঁহার নিকট চিরঋণী থাকিবে। পূর্ববর্তী গায়কগণের মধ্যে মানসিংহের তুল্য গায়ন বিশারদ কদাচিৎ মেলে এবং পরমাত্মার কী অপার লীলা যে, তাঁহার তুল্য ধ্রুপদ গীত রচনা করা অপরের পক্ষে অসম্ভব।’
সংগীতজ্ঞ রাজা মানসিংহ তোমর [ Raja ManSingh Tomar ] এর বিয়ে সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। একবার তিনি শিকার করতে গিয়ে দেখতে পান, বনের মধ্যে এক সুন্দরী মেয়ে নিজ শক্তিবলে বুনো মহিষের শিং হাত দিয়ে ধরে বশ মানাচ্ছে। গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ এই বীরাঙ্গনার সাহসে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন এই সুন্দরী ও সাহসী কন্যা তার জন্য একটি নিজস্ব মহল এবং মহল থেকে এগারো মাইল দূরে পৈতৃক বাসস্থান ‘রাইগাঁও’ পর্যন্ত খাল খনন করে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার আবেদন জানায়।
ডকুমেন্টরি:
প্রাজ্ঞ রাজা তার এই সহৃদয় ও উদার শর্ত স্বীকার করে তাকে রানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। মানমন্দিরের কাছাকাছি ‘গুজরীমহল’ নামে একটি প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং একটি খাল খনন করে রাইগ্রাম হতে গোয়ালিয়রের গুজরীমহলে পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। রানী গুজরী সংগীত শিক্ষা লাভের ইচ্চা পোষণ করলে নায়ক বৈজু বাওরা তাঁকে সংগীত শিক্ষা প্রদান করেন।
রানীর নামানুসারে গুজরীটোরি, মঙ্গলগুজরী ইত্যাদি রাগ রচিত হয়। তোমর বংশ শিল্পানুরাগী হওয়ায় সেই পরিবেশে রাজমহিষী পরবর্তীকালে সংগীতনিপুণা এবং অসীম গুণের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অসামান্য বীর নারী, উদার ও সংগীতনিপুণা রানী গুজরী ওরফে মৃগনয়নী রাজা মানসিংহ তোমরের যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন। ইতিহাসখ্যাত সংগীতসাধক মিয়া তানসেন মহারানীর কাছে কিছুকাল সংগীতশিক্ষা লাভ করেন বলে জানা যায়।
সংগীতসেবায় নিবেদিতপ্রাণ বিদগ্ধ সংগীতানুরাগী, স্রষ্টাশিল্পী ও সংগীতশাস্ত্রকার রাজা মানসিংহ তোমর ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ) পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারের উদ্দেশে যাত্রা করেন।