উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির একটি সুপরিচিত রাগ হলো ভূপালী, যা কল্যাণ ঠাটের অন্তর্গত। রাগটি তার সরলতা, সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিক গভীরতার জন্য শাস্ত্রীয় ও লোকপ্রিয় উভয়ভাবে সমাদৃত। ভূপালী রাগে মধ্যম (ম) এবং নিশাদ (নি) বাদ দেওয়া থাকে, যা রাগটির সৌন্দর্যকে আরও নিরপেক্ষ ও মনোমুগ্ধকর করে।
ভূপালীর চলনে ধৈবত (ধ) ব্যবহৃত হয়, যা ষড়্জের স্পর্শ যুক্ত করে এক অনন্য সঙ্গীত অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এর স্বরবিন্যাসের সঙ্গে দেশকার এবং পাহাড়ি রাগের মিল লক্ষ্য করা যায়। তবে দেশকার ও পাহাড়ি রাগের চলনের মধ্যে বিলাবল অঙ্গের প্রভাব বিদ্যমান। পক্ষান্তরের ভূপালীর চলনের সঙ্গে কল্যাণ অঙ্গের মিল পাওয়া যায়, যা রাগটির সৌন্দর্য ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে।
দেশকারে ভূপালী রাগের তুলনায় গান্ধার (গ) প্রয়োগ কম। ফলে, ভূপালীতে গান্ধার বাদীস্বর, কিন্তু দেশকারে গান্ধার সমবাদী স্বর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পঞ্চম স্বর (প) দেশের ভূপালীর তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হলেও, পাহাড়ি রাগের মতো প্রবল নয়; পাহাড়ি রাগে পঞ্চম স্বর সমবাদী স্বর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভূপালী রাগের স্বরবিন্যাস এবং প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
রাগ ভূপালী – মৌলিক তথ্য
বৈশিষ্ট্য | বিবরণ |
---|---|
আরোহণ (Arohana) | স র গ প ধ র্স |
অবরোহণ (Avarohana) | র্স ধ প গ র স |
ঠাট (Thaat) | কল্যাণ |
জাতি (Jaati) | ঔড়ব-ঔড়ব |
বাদীস্বর (Vadi) | গ |
সমবাদী স্বর (Samvadi) | ধ |
অঙ্গ (Anga) | পূর্বাঙ্গ |
সময় (Samay) | রাত্রি প্রথম প্রহর |
পকড় (Pakad) | স ধ্, স র প গ, র স |
ভূপালী রাগের পকড় এবং স্বরবিন্যাসের মাধ্যমে শিল্পীরা এটি যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। পকড় হলো সেই সংক্ষেপিত রূপ, যা রাগের মৌলিক লহরী এবং আঙ্গিক প্রকাশ করে। ভূপালী রাগে স্বরের সরলতা ও ধৈবতের ব্যবহার একত্রে শোনা যায়, যা শ্রোতাদের মনে এক ধরনের শান্তি ও আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টি করে।
রাগটির প্রাচীন সাহিত্য ও সঙ্গীত গবেষণায় উল্লেখ আছে যে, ভূপালী রাগের চলন ও ধ্বনি শাস্ত্রীয় উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এটি শুধুমাত্র কল্পনা ও আবেগের জন্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক উন্মেষ, ধ্যান এবং নৃত্যসংগীতের জন্যও বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
ভূপালী রাগের দেশকার ও পাহাড়ি রাগের তুলনা থেকে বোঝা যায়, কিভাবে স্বর ব্যবহার এবং অঙ্গরূপের পার্থক্য রাগের সৌন্দর্যকে নির্ধারণ করে। এছাড়া পক্ষান্তরের কল্যাণ অঙ্গ এবং বাদী-সমবাদী স্বরের সম্পর্ক রাগের সঙ্গীতিক প্রাসঙ্গিকতা ও আভিজাত্য বৃদ্ধি করে।
উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় রাগব্যবস্থায় ভূপালী রাগের গুরুত্ব অত্যন্ত বিশাল। এটি শুধুমাত্র রাত্রি প্রহরে নয়, বরং সঙ্গীতচর্চার জন্য অনন্য মানদণ্ড স্থাপন করে। ভূপালীর সরলতা, ধৈবত ব্যবহার এবং কল্যাণ ঠাটের সংযোজন শিল্পীর সৃজনশীলতাকে অনন্য মাত্রা দেয়।
তথ্যসূত্র
-
উচ্চাঙ্গ ক্রিয়াত্মক সঙ্গীত। শক্তিপদ ভট্টাচার্য। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭।
-
রাগ বিন্যাস (প্রথম কলি)। শ্রীশচীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য। এস, চন্দ্র এন্ড কোং। শারদীয়া সপ্তমী, সেপ্টেম্বর ১৯৭৬।
-
রাগশ্রেণী। পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। ১৩৫৩। পৃষ্ঠা: ২৫-২৭।
-
সঙ্গীত পরিচিতি (উত্তরভাগ)। শ্রীনীলরতন বন্দ্যোপাধ্যায়। ৫ই ভাদ্র ‘৮০। ২১ আগস্ট ‘৭৩।