রাগ ভৈরবী উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাগ এবং একইসাথে ভৈরবী ঠাটের জনক রাগ হিসেবে পরিগণিত। এর নামকরণ এসেছে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির ভৈরবী দেবীর নাম থেকে। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, ভৈরবী ছিলেন চৌষট্টি যোগিনীর অন্যতম এবং দেবী দুর্গার সহচরী। দক্ষযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে সতীর আত্মবিলয়ের পর, শিবের তাণ্ডব নৃত্যের ফলে পৃথিবী ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেলে, বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৬৪ খণ্ডে বিভাজন করেন। এসব খণ্ড পতিত হয়ে যেসব স্থান গঠিত হয়, সেগুলিই শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। প্রতিটি পীঠের অধিষ্ঠাত্রী শক্তির নাম ভৈরবী, যিনি ভৈরব দেবতার স্ত্রীরূপে পূজিত হন।
এমন পৌরাণিক গভীরতা থেকেই রাগ ভৈরবী নামকরণের উৎস। এই নাম যেমন শাস্ত্রীয় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তেমনি এর সুরের গম্ভীরতা, কোমলতা ও রসাত্মকতা এই পৌরাণিক ব্যঞ্জনাকে পরিপূর্ণ করে।
রাগ ভৈরবীর সংগীততাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
ঠাট: ভৈরবী
জাতি: সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ (ষড়জ থেকে নিষাদ সব সাতটি স্বরই ব্যবহৃত হয়)
আরোহণ: স ঋ গ ম প দ ন স
অবরোহণ: স ন দ প ম গ ঋ স
বাদী স্বর: মধ্যম (ম) (মতান্তরে পঞ্চম)
সমবাদী স্বর: ষড়জ (স)
অঙ্গ: পূর্বাঙ্গ
সময়: সাধারণত সকালবেলা, তবে যে কোনও সময় পরিবেশনে উপযুক্ত
পকড়: ঋ ন দ স – গ – স ঋ স ন স
রাগ ভৈরবীর ঐতিহাসিক রূপান্তর
রাগ ভৈরবী প্রাচীনকালে কাফি ঠাটের সুরসৌন্দর্য ধারণ করে গড়ে উঠেছিল। ‘রাগতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে লোচন পণ্ডিত বলেন, কাফি ঠাটের সরল আরোহণ-অবরোহণের ধারা অনুসরণ করলেই ভৈরবীর রূপ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে কেউ কেউ এতে কোমল ধৈবতের প্রয়োগ করতেন, যা রাগটিকে আশাবরী ঠাটের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
দক্ষিণ ভারতে এই রাগটি প্রচলিত আছে ‘ভৈরবী’ নামে, আবার গোবিন্দাচার্য এর নাম দিয়েছেন ‘নটভৈরবী’। বিভিন্ন মনীষীর ভিন্নমত থাকলেও, রাগটির ব্যবহারিক প্রয়োগ ও ভাবগম্ভীর রূপ ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা এবং রাগপ্রধান গানে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
পণ্ডিত পুণ্ডরীক, তাঁর ‘রাগমঞ্জরী’ গ্রন্থে, ভৈরবী রাগটিকে গৌরী ঠাট (বর্তমানে ভৈরব ঠাট) এর অন্তর্গত বলেছেন। ফলে, বিভিন্ন সময়ে এই রাগকে ভিন্ন ঠাটে সংযুক্ত করা হলেও আজকাল একে ভৈরবী ঠাটের অধীনেই ধরা হয়।
চর্যাপদে রাগ ভৈরবীর প্রয়োগ
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম সংগীতধর্মী কাব্য ‘চর্যাপদে’ (৬৫০–১২০০ খ্রিস্টাব্দ) রাগ ভৈরবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে মোট ৪টি পদ এই রাগে রচিত হয়েছে (পদ নং ১২, ১৬, ১৯, ও ৩৮)। এটি প্রমাণ করে যে রাগ ভৈরবী বাংলা সঙ্গীতের প্রাচীনতম স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে রেখেছে।
দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের রূপভেদ
- দক্ষিণ ভারতে ভৈরবী রাগটি দারুণ জনপ্রিয়। কর্ণাটক সঙ্গীতে এটি ‘ভৈরবী’ নামেই প্রচলিত এবং অনেক সময় এটি তেলুগু ভজন বা কীর্তনায় ব্যবহৃত হয়।
- উত্তর ভারতে এই রাগটি মূলত ঠুমরি, ভজন ও গজলের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে, যেখানে কোমল স্বরের প্রাধান্য থাকে।
রাগ ভৈরবী শুধুমাত্র একটি রাগ নয়, এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক অনন্য ঐতিহ্য, যার পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনির গৌরব, শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের গাম্ভীর্য এবং লোকসংগীতে তার প্রয়োগের অসীম বৈচিত্র্য। চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সঙ্গীতেও রাগ ভৈরবীর প্রভাব ও আবেদন চিরন্তন।
আরও পড়ুন: