শাক্তপদাবলী ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

শাক্তপদাবলী ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আজকের আলোচনা। কীর্তনের সমসাময়িক কালেই শাক্তপদাবলীর উৎপত্তি। বৈষ্ণব সাধানার শ্রেষ্ঠ সাঙ্গীতিক রূপ যদি হয় কীর্তন তাহলে শক্তি সাধনার শ্রেষ্ঠ সুরের অভিব্যক্তি ঘটেছে তার শাকসঙ্গীতে। বৈষ্ণবপদাবলী যেমন রাধাকৃষ্ণর প্রেমলীলা অবলম্বনে রচিত শাক্তপদাবলী তেমনি শ্যামা বা কালীকে কেন্দ্র করে রচিত। এছাড়া আছে উমা সম্বন্ধে আগমনী বা বিজয়ার গান।

শাক্তপদাবলী ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

সতের (১৭০০খ্রীঃ) শতাব্দীতে বাঙালী মানস চেতনায় বৈষ্ণব ভাবপ্লাবন অনেকটা মন্দীভূত হয়ে এলো এবং রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা প্রভাব ছেড়ে মাতৃশক্তি উপাসনা প্রাধান্য লাভ করলো। শাক্তপদাবলী নামের মধ্যেই শাক্তভাবের ইঙ্গিত রয়েছে। মাতৃসঙ্গীত কালীসঙ্গীত চণ্ডীগীতি, মানসীগান, বিজয়া, আগমনী এই সঙ্গীতের কয়েকটি সুপরিচিত রূপ।

শাক্তপদাবলীতে রাগের ব্যাপকতায় ভিন্ন মাত্রা সংযোগ না হলেও শাক্তপদাবলীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাধান্য ছিল। তা রাম প্রসাদ সেনের শাক্তপদাবলী হতে পাওয়া যায় । অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রাম প্রসাদ (১৭১৮-১৭২৩) যেকোন সময়ে নৈহাটির কুমারহট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাম প্রসাদ একাধারে ভক্তসাধক ও কবি। রাম প্রসাদের গান রাগসঙ্গীত ধারা ছাড়া সহজ, সরল, রামপ্রসাদী (দেশীসুরে) সুরে গীত হতো। শাক্তপদাবলীতেও রাগসঙ্গীতের এর মান মেলে, যেমনঃ

“এমন দিন কি হবে তারা যবে তারা
তারা বলে তারা বেয়ে পড়বে ধারা।”
এই গানটি কাফিরাগে, যৎ তালে এবং টপ্পা আঙ্গিকে রচিত।
তেমনি, কমলাকান্তের একটি শাক্তগীতি
“আমার সাধ না মিটিল
আশা না পুরিল সকলি ফুরিয়ে যায় মা,
এ গানটি পরিপূর্ণতায় রাগভিত্তিক না হলেও কোন না কোন ভাবে”

 

রাগভিত্তিক-

বাণী ও সুর বৈচিত্রতায়-গানটি পরিপূর্ণতা পেয়েছে।

তেমনি রামপ্রাসদের-

মা বলে ডাকি যদি

দিসনে সারা দিসনে সারা।

গানটি দেশরাগে-দাদরা তালে

শাক্তগীতির আর একজন সার্থক রূপকার কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাজী । নজরুল শাক্তগীতিতে তার অবস্থানকে সার্থক তথা বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন।

যথা

কে পড়াল মৃন্ডমালা
গানটি দাদরা তালে এবং ভূপালী রাগে

 

 

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, শাক্তগীতিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার নান্দনিকভাবেই রয়েছে।

 

শাক্ত পদাবলীর পরিচয়:

অষ্টাদশ শতকের শুরুতেই সমগ্র গৌড়বঙ্গ জুড়ে দেখা দিয়েছিল অমানিশার অন্ধকার। মোগল সম্রাটদের রাজত্বকালে দেশে মোটামুটিভাবে যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল অব্যাহত, ঔরংজীবের মৃত্যুর পর তা’ হল অন্তর্হিত বাংলার সমাজ-জীবনেও তখন বিপর্যস্ত অবস্থা, চৈতন্যদেবের প্রভাব ক্রমবিলুপ্তির পথে। বৈষ্ণবের প্রেমধর্ম সহজিয়া পন্থা অবলম্বন করে যে তৎকালিক রূপ লাভ করেছিল, সমাজের শিষ্ট সম্প্রদায় তাকে ‘ন্যাড়ানেড়ির’ কাণ্ড বলে তা থেকে শতহস্ত দূরে সরে গিয়েছিলেন। দেশের এই সামূহিক অবক্ষয়ের যুগে আলোকবর্তিকা হাতে দেখা দিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ শাক্ত সাধনার একটি উচ্চস্তরে আরোহণ কাঁরে তিনি রচনা করলেন কিছু সাধনসঙ্গীত— একালে আমরা এগুলিকেই ‘শাক্তপদাবলী’ নামে অভিহিত ক’রে থাকি।

প্রাক্‌-চৈতন্য যুগেই আমাদের দেশে রাধাকৃষ্ণ-কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল বৈষ্ণব পদাবলী’। আদি বৈষ্ণবপদকর্তা জয়দেব গোস্বামী তাঁর ‘গীতগোবিন্দে’র রচনাকে ‘পদ’ নামে অভিহিত করায় পরবর্তীকালে রচিত অনুরূপ রচনাকে ‘বৈষ্ণবপদ’ নামেই পরিচায়িত করা হতো। রামপ্রসাদ-কর্তৃক প্রবর্তিত দেবী-বিষয়ক গানগুলিকে একালে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর সাদৃশ্যে ‘শাক্তপদাবলী’ নামে অভিহিত করে থাকি। কিন্তু বিভিন্ন কালে এই গানগুলি ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রচলিত ছিল।

এ জাতীয় গানগুলি প্রধানত রামপ্রসাদ-রচিত অথবা তার অনুসরণে রচিত বলে এগুলিকে ‘রামপ্রসাদী গান’ বা ‘প্রসাদী সঙ্গীত’ নামেও অভিহিত করা হয়। আবার সঙ্গীতের প্রধান বিষয় ‘শ্যামা’ বা ‘কালী’ বলে এর নামাত্তর ‘শ্যামাসঙ্গীত’ ও ‘কালীকীর্তন’। চর্যাপদে এবং সঙ্গীত শাস্ত্রে ‘মালসী’ (মালবশ্রী রাগিণীর উল্লেখ আছে, কেউ কেউ ভবানী বিষয়ক গানকেও ‘মালসী’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘সঙ্গীত দামোদর’ গ্রন্থে দুর্গাপূজার অব্যবহিত পূর্ববর্তীকালে গেয় গানকে ‘মালসী’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। দুর্গার অপর নাম ‘আগমনী’ – এই হেতু কচিৎ কেউ যাবতীয় শাক্ত সঙ্গীতকেই ‘আগমনী’ আখ্যা দিতে চান— যদিও এজাতীয় গানের একটি বিশেষ অংশের নামই শুধু ‘আগমনী’ বলে সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেছে।

Leave a Comment