শারঙ্গদেব : প্রাচীনকালের শাস্ত্রীয় গ্রন্থে লেখক পরিচিতি দেওয়ার কোনো রীতি ছিল না। তাই কোনও শাস্ত্রকারের নাম ছাড়া আর কিছু জানতে হলে অপরের উক্তি বা প্রচলিত কাহিনীর ওপরই নির্ভর করতে হয়। অবশ্য যে কয়েকজন পণ্ডিত নিজেদের বংশপরিচয় তাঁদের রচিত গ্রন্থে সংক্ষেপে লিখেছিলেন তাঁদের মধ্যে পণ্ডিত শারঙ্গদেব একজন।
শারঙ্গদেবের পূর্বপুরুষরা ছিলেন কাশ্মীরের অধিবাসী এবং যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ। এ বংশের প্রতিভাবান পুরুষরা স্থানীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দক্ষিণ ভারতে চলে যান। ভাস্করের পুত্র সোডল দেবগিরির (বর্তমান দৌলতাবাদ, মহারাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত) যাদব বংশীয় রাজা ভিল্লম (১১৮৫-১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) ও পরে তাঁর পুত্র সিংহনের দরবারে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন।
শারঙ্গদেব
সিংহনের রাজত্বকালে (১২০৫-৪৭, মতান্তরে ১২০৮-৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) সোডলের পুত্র শারঙ্গদেবের জন্ম হয়। কোনও কোনও সংগীত গুণীজন ধারণা করেন ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন ভারতীয় সংগীতের কিংবদন্তি জ্যোতিষ্ক শারঙ্গদেব। অসাধারণ প্রতিভাবান শারঙ্গদেব অল্প বয়সেই নানা বিদ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন এবং শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে রাজাশ্রয় লাভ করার ফলে সংগীতসহ অন্যান্য বিদ্যায় সুপণ্ডিত হওয়ার সুযোগ পান।
লেখাপড়া ও সংগীতচর্চা নিয়েই তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটত। সেই সঙ্গে তিনি চিকিৎসকের কাজও করতেন। অবশ্য নিজেকে তিনি শ্রীকরণাগ্রণী বলে পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন করণ বা দপ্তরের প্রধান কর্মচারী। তাঁর ডাকনাম ছিল নিঃসঙ্ক। তাই তাঁর উদ্ভাবিত বীণার নাম রেখেছিলেন ‘নিঃসঙ্কবীণা’।
সে সময় প্রাপ্ত যাবতীয় সংগীতশাস্ত্র অধ্যয়ন করে আনুমানিক ১২৪৮-৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি সঙ্গীত রত্নাকর গ্রন্থটি রচনা করেন। যা স্বরাধ্যায়, রাগাধ্যায়, প্রকীর্ণাধ্যায়, প্রবন্ধাধ্যায়, বাদ্যাধ্যায়, তালাধ্যায় ও নৃত্যাধ্যায় এই সাতটি পরিচ্ছেদ নিয়ে সম্পন্ন। মধ্যযুগে সংগীতবিষয়ক এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থ আর পাওয়া যায়নি।
এই গ্রন্থে সাংগীতিক যাবতীয় বিষয় সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি ভরত ও মতঙ্গের অনুগামী শাস্ত্রকার হলেও পূর্বসূরি আচার্যদের প্রমাণবাক্যের উল্লেখ সহযোগে প্রাচীন ও সমসাময়িক সংগীতের পরিচয় দিয়েছেন। গান্ধর্বগীত সম্বন্ধে তিনি যেমন আলোচনা করেছেন তাতে মনে হয় ওই রীতির ওপর তাঁর প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল ।
ভারতীয় সংগীতে মধ্য এশিয়ার প্রভাব, প্রাচীন সংগীতের ক্রমবিবর্তন, বহুবিচিত্র গীতরীতির জন্ম-ইতিহাস, এমনকি স্বরলিপিসহকারে সংগীত সংরক্ষণের প্রচেষ্টাও তিনি করেছেন। এছাড়া ভরত-বর্ণিত চলাচল বীণার সাহায্যে বাইশটি শ্রুতি ও স্বরস্থান নিরূপণের বিষয়টিরও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি অভিজাত সংগীতেরই বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, প্রয়োগ ক্ষেত্রে যা সত্য তাই প্রকৃত শাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবহেলিত শাস্ত্রের কোনো মূল্য নেই। তিনি স্বীকার করেছেন যে, গান্ধর্ব বা মার্গসংগীত গ্রন্থের পাতায় আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত হচ্ছে দেশি সংগীত, যা নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং কালানুগত বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ রাখে না।
সঙ্গীত রত্নাকর গ্রন্থটি সংগীতজগতের একটি অমূল্য রত্নবিশেষ এবং সমগ্র উপমহাদেশে প্রামাণ্য পুস্তক হিসেবে স্বীকৃত। এই গ্রন্থের দুরূহ বিষয় সম্পর্কে সহজবোধ্য টীকা রচনা করে পরবর্তীকালে সিংহভুপাল (১৪০০ শতাব্দী) এবং কল্পিনাথ (১৫০০ শতাব্দী) যশস্বী হয়েছেন। এই গ্রন্থ সম্পর্কে সিংহভুপাল বলেছেন যে –
‘শারঙ্গদেবের আবির্ভাবের পূর্বে ভরত আদি পূর্বাচার্যদের বর্ণিত সকল সাঙ্গীতিক উপকরণ পদ্ধতি যখন দুর্বোধ্য তথা লুপ্ত হতে চলেছিলো, তিনিই সেসকল মূল্যবান তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করিয়াছেন’।
এই গ্রন্থে বর্ণিত বহু বিচিত্র রাগের মধ্যে মালব, গৌড়, কর্ণাট, বাঙালি, দ্রাবিড়, সৌরাষ্ট্র, গুর্জর ইত্যাদি রাগনাম প্রদেশ বিশেষের নামের সঙ্গে সম্বন্ধ সূচনা করে। সে-সময় এই রীতিতে রাগের নামকরণ করা হতো বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া তুরস্কতোড়ি, তুরস্কগৌড় ইত্যাদি রাগের প্রতিপাদন প্রমাণ করে যে, তখন সংগীতে মুসলমানদের প্রভাব দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
শারঙ্গদেব বর্ণিত শুদ্ধরাগ ‘মুখারী’ বর্তমান কর্ণাটকি সংগীতে ‘কনকাঙ্গী’ নামে পরিচিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে এই বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও সংগীতশাস্ত্রকার নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অন্ত সুরালোকে গমন করে।
আরও পড়ুন: