শিখ সঙ্গীত শিখ ধর্ম ও সংস্কৃতির এক গভীর ও ঐশ্বর্যময় অংশ। এটি মূলত শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহেব-এ সংরক্ষিত পবিত্র বাণীকে সুর ও ছন্দের মাধ্যমে পরিবেশন করার একটি ধারাবাহিক আধ্যাত্মিক চর্চা। এই ধারাটিকে বলা হয় গুরবাণী কীর্তন, যা কবিতা, রাগ ও তালের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করে এক অতুলনীয় আত্মিক অভিজ্ঞতা।
Table of Contents
উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক পটভূমি
শিখ সংগীতের সূচনা ঘটে ১৫শ শতকে, শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক দেব জি-র সময়। তিনি স্বয়ং বহু শবদ রচনা ও পরিবেশন করেন, আর তার সঙ্গী মুসলিম বাদ্যকার ভাই মারদানা তার সঙ্গে রবাব বাজাতেন। ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের এই দৃষ্টান্তই পরবর্তীকালে শিখ সংগীতের মূল ভাবধারায় রূপ নেয়।
পরবর্তী গুরুদের মাধ্যমে এই সঙ্গীত ধারা আরও সমৃদ্ধ হয়। বিশেষ করে গুরু অর্জুন দেব জি শিখদের ধর্মগ্রন্থ আদি গ্রন্থ সংকলন করেন এবং তাতে ৩১টি মূল রাগ ও উপ-রাগ নির্ধারণ করেন, যা শিখ সংগীতের ভিত্তি গড়ে দেয়।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য
শিখ সংগীতের কেন্দ্রে থাকে গুরবাণী, অর্থাৎ পবিত্র শবদ বা বাণী, যা নির্দিষ্ট রাগ ও তাল-এ পরিবেশিত হয়।
রাগ
প্রতিটি শবদ নির্দিষ্ট রাগে বাঁধা থাকে। এই রাগ নির্ধারণ করে গানটির মেজাজ, পরিবেশনের সময় এবং সুরের গঠন। ব্যবহৃত রাগগুলির মধ্যে রয়েছে: আসা, ভৈরব, সারং, টোড়ি, কাল্যাণ প্রভৃতি।
তাল
শিখ সংগীতে তাল ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তীনতাল, ঝপতাল প্রভৃতি হিন্দুস্তানি তাল ব্যবহৃত হয়, তবে কীর্তনের ক্ষেত্রে অনেক সময় সেগুলির সহজতর রূপ ব্যবহৃত হয়, যাতে শ্রোতারা সহজেই মগ্ন হতে পারেন।
শবদ
শবদ হলো গানটির মূল বাণীভিত্তিক অংশ। এর অর্থ ও ভাব প্রকাশই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই গায়কগণ সাধারণত উচ্চারণ, আবেগ ও স্পষ্টতা বজায় রেখে পরিবেশন করেন।
শিখ সংগীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র
প্রাচীন শিখ সংগীতে ব্যবহৃত হতো মূলত তারযুক্ত ও মৃদঙ্গবাদ্য:
- রবাব: গুরু নানক দেবের সংগীতে ব্যবহৃত অন্যতম প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র।
- তাউস: ময়ূরাকৃতি তারযন্ত্র, গুরু হরগোবিন্দ জি প্রবর্তন করেন।
- দিলরুবা, সারঙ্গি: সুর পরিবেশনার জন্য ব্যবহৃত।
- জোড়ি, মৃদঙ্গ: ছন্দ ও তাল রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে হারমোনিয়াম ও তবলা অধিক প্রচলিত, তবে ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রগুলির পুনরুজ্জীবনেও আগ্রহ বাড়ছে।
গুরদোয়ারায় কীর্তনের চর্চা
শিখ সঙ্গীত পরিবেশনের প্রধান স্থান হল গুরদোয়ারা, অর্থাৎ শিখ উপাসনালয়। এখানে কীর্তন—গুরবাণীর সঙ্গীত পরিবেশন—সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু। রাগী (শিক্ষিত সঙ্গীতজ্ঞরা) পরিবেশন করেন, কখনও এককভাবে, কখনও দলে।
গান পরিবেশন সাধারণত প্রশ্ন-উত্তর ধাঁচে হয়, যাতে গুরদোয়ারার উপস্থিত সকলে অংশ নিতে পারেন। এটি সৃষ্ট করে সমবায়ী ভাবনা, একাত্মতা ও আত্মিক প্রশান্তি।
রীতিনীতির বৈচিত্র্য
শিখ সংগীতে বিভিন্ন গায়নধারা রয়েছে:
- ধ্রুপদ ধারা: ধ্যানমগ্ন ও মার্জিত, প্রাচীন শিখ সংগীতে প্রচলিত।
- খেয়াল ধারা: অলঙ্করণসমৃদ্ধ ও উদার, অনেক কীর্তন পরিবেশনায় ব্যবহৃত।
- নামধারি রীতি: এই সম্প্রদায় এখনও প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র ও রাগ ব্যবহার করে কীর্তন পরিবেশন করেন।
- পাঞ্জাব ঘরানা: শিখ কীর্তনের আধুনিক রূপে যেটি প্রচলিত।
সংরক্ষণ ও পুনর্জাগরণ
ঔপনিবেশিক প্রভাব এবং পাশ্চাত্য যন্ত্রের আগমনে শিখ সঙ্গীত তার মূল ধারার কিছু অংশ হারিয়ে ফেলে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বহু সঙ্গীতজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠান কাজ করছেন শিখ সংগীতের রাগভিত্তিক ঐতিহ্য ও তাঁতির সায (তাঁতিযুক্ত বাদ্যযন্ত্র) পুনরুদ্ধারের জন্য।
পাঞ্জাব ও বিদেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠন এখন শিখ সঙ্গীতচর্চা ও গবেষণা পরিচালনা করছে, এবং ডিজিটাল সংরক্ষণাগার তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও বিস্তার
বর্তমানে শিখ সঙ্গীত সারা বিশ্বে—পাঞ্জাব থেকে লন্ডন, টরন্টো ও সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত—বিস্তৃত। প্রবাসী শিখ সম্প্রদায় নতুন প্রজন্মের জন্য বহুভাষিক, ফিউশনভিত্তিক কীর্তনের মাধ্যমে এ ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
শিল্পী ভাই বলদীপ সিং, রাগিনী রায়নু, এবং মানিকা কউর প্রমুখ আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী কীর্তনের প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।