শিল্পী তানসেনের প্রকৃত নাম রামতনু পাণ্ডে। তাঁহার পিতার নাম মুকুন্দ পাণ্ডে বা মকরন্দ পাণ্ডে। তানসেনের জন্ম সন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণ বহু মত পোষন করিয়াছেন। কেহ কেহ বলেন ১৫০৬ খ্রি: আবার কেহ কেহ বলেন ১৫২০ খ্রিস্টাব্দ। তবে যাহাই হউক তাঁহার জীবনকাল পর্যালোচনা করিলে এই দুই মধ্যবর্তী সনের কোন একটি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক ড. বিমল রায় তাঁহার “ভারতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গ” গ্রন্থে অনেক যুক্তিতর্কের মধ্যে দিয়া ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দকেই তানসেনের জন্ম বলিয়াছেন।
শিল্পী তানসেন । শিল্পী জীবনী
শিল্পী তানসেন তাঁহার জীবনে দুইজন প্রসিদ্ধ সঙ্গীতগুরুর কাছে শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন। একজনের নাম মুহম্মদ গাউস এবং অপর জন হইলেন হরিদাস স্বামী। তবে ইনি কোন হরিদাস এ সমন্ধে মতেভেদ আছে। কেননা হরিদাস নামে আরও কয়েকজন সঙ্গীতজ্ঞের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
শিল্পী তানসেন গোয়ালিয়রের মহারাজা সিংহের পত্নী মৃগনয়নীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যাপীঠের এক বিদ্যার্থিনীর সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উক্ত বিদ্যার্থিনী পূর্বে মারাঠী ব্রাহ্মণ ছিলেন; কিন্তু সামাজিক অত্যাচারের তিনি এবং তাঁহার পিতা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। সুতরাং তানসেনকেও মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়া উক্ত বিদ্যার্থিনীকে বিবাহ করিতে হয়। তখন তাঁহার নামকরণ হয় আতা আলি খান।
কথিত আছে রামতনু প্রথমে রেওয়ার রাজা রামচন্দ্রের সভা-গায়ক ও সঙ্গীতগুরু ছিলেন। ঘটনাক্রমে আকবরের সহিত রামতনুর সাক্ষাৎ হয় এবং সেই সময় তানসেনের গানে আকবর মুগ্ধ হন এবং তখনই রামচন্দের অনুমতিক্রমে তানসেনকে নিজের রাজসভায় লইয়া আসেন। ১৫৫৬ খ্রী: তানসেন দিল্লীর সম্রাট আকবরের সভাগায়ক হন ।
কথিত আছে যে আকবর তাঁহার গানে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে তানসেন উপাধিতে ভূষিত করেন ও স্বীয় কণ্ঠের রত্নমালা উপহার দেন। আকবরের সভায় নবরত্মদের মধ্যে তানসেন অন্যতম। তানসেন সঙ্গীতজগতে প্রভূত প্রতিভার সাক্ষ্য রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি শিল্পী, কবি ও সুরস্রষ্টা ছিলেন। তিনি বহু ধ্রুপদ গান রচনা করিয়াছিলেন। তত্তালে ধ্রুপদ গানকে তিনি মর্যাদার তুঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।
প্রাচীন রাগের সহিত কিছু সংমিশ্রণ ঘটাইয়া উনি প্রচুর রাগ সৃষ্টি করেন যাহা আজও তানসেনের অপূর্ব সঙ্গীত প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে। তাঁহার সৃষ্ট দরবারী কানাড়া, মিয়াকী টৌড়ী, মিয়াকী মল্লার, মিয়াকী সারং প্রভৃতি বহু রাগ আজও শ্রোতাবৃন্দের কানে সুধা বর্ষণ করে। প্রাচীনকালের ধাতুকে উনিই স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগে এই চারটি বিভাগে ভাগ করিয়াছিলেন। সাত স্বরের পরিবর্তে রাগের মধ্যে আট নয়টি স্বর তিনি ব্যবহার করেন।
ভারতীয় সঙ্গীতে তিনি একজন নূতন অধ্যায়ের প্রবর্তক ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। কথিত আছে ইনি রুদ্রবীণা ও রবাব এই দুইটি উন্নযন্ত্রের স্রষ্টা এবং এই দুইটি যন্ত্রের বিশিষ্ট একজন বাদকও ছিলেন। তানসেনের চার পুত্র ও এক কন্যা ছিল। পুত্রদের নাম তানতরঙ্গ, সুরৎ সেন, বিলাস খা, ও শরৎ সেন এবং কন্যার নাম স্বরস্বতী। সকলেই সঙ্গীতনিপুণ ছিলেন। “বিলাসখা টৌড়ী” রাগটি তানসেনের পুত্র বিলাস খাঁর দ্বারা সৃষ্ট। ১৫৮৯ খ্রি: ভিন্নমতে ১৫৯৫ খ্রি: তিনি পরলোক গমন করেন। সঙ্গীতাকাশে তানসেন সর্বকালের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। সঙ্গীতজগতে তাঁহাকে একজন চিরন্তন সঙ্গীত সম্রাট বললেও অত্যুক্তি হয় না।
আরও দেখুনঃ