সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ | সঙ্গীতের ইতিহাস: সঙ্গীত শাস্ত্রাদিতে কথিত আছে যে, অতি প্রাচীনকালে ব্রহ্মা সংগীতবিদ্যা সৃষ্টি করে শিবকে এবং শিব সরস্বতীকে দান করেন; পরবর্তীকালে ভূলোকের ভরত, নারদ প্রমুখ মহর্ষিরা কঠোর সাধনায় সংগীতবিদ্যা লাভ করেন। তবে ইতিহাসের ভিত্তিতে আমরা জানি যে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মতঙ্গের সময় পর্যন্ত বৈদিক যুগ হিসাবে স্বীকৃত এবং তখন সামগান, গাথা প্রভৃতির প্রচলন তথা চার থেকে সপ্ত স্থরের বিকাশ হয়েছিল। এর মধ্যে আবার ভরত-পূর্ব এবং ভরতের পরবর্তীকালকে যথাক্রমে ক্লাসিকাল যুগ ও বৈদিক যুগ বলা হয়। অর্থাৎ রামায়ণ, মহাভারত, নাট্যশাস্ত্র প্রভৃতির রচনাকালকে নিয়ে কিছু অংশ হোল ক্লাসিকাল যুগ । যখন গ্রাম, মূর্ছনা, জাতি প্রভৃতি সংগীত পদ্ধতির প্রচলন ছিল।
সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ | সঙ্গীতের ইতিহাস
সঙ্গীতে তখন রাগের বিকাশ ছিল কিনা, তা নিয়ে মতভেদ আছে। সংগীতশাস্ত্রী P. Sambomoorthy বলেছেন:
“The vedic hymns of this period constitute the oldest hymnal music of humanity. During the post-Bharata period, the raga concept steadily grew until it reached its perfection in the time of Matanga [ P. Sambomoorthy History of Indian Music. 1960].
অবশ্য তখন রাগ শব্দের প্রচলন না থাকলেও, যাবতীয় সংগীতে রঞ্জকতা যে পরিপূর্ণরূপে ছিল সে বিষয়ে অনেকেই একমত।
রামায়ণ মহাভারতাদিতে বহু বিচিত্র সাংগীতিক উপাদানাদির পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময়কালকে সামগানের যুগ বলা যায়। সামগানোত্তর যুগে জাতিরাগাদির বিকাশ হয়। অর্থাৎ পরবর্তী ক্রমবিকাশ হিসাবে জাতিরাগ, গ্রামরাগ, অভিজাত দেশীরাগ প্রভৃতির স্তরগুলি উল্লেখযোগ্য।
ক্লাসিকাল যুগের শেষের দিকে কোহল, যাষ্টিক, বিশ্বাবস্থ মতঙ্গ প্রমুখ সংগীতাচার্যেরা শুদ্ধিষজ্ঞের ব্যবস্থা করেন। যার সাহায্যে বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক (folk) ও জাতীয় স্বর রচনাগুলিকে পরিশুদ্ধ করে শাস্ত্রীয় রাগ সঙ্গীত বা অভিজাত দেশীসংগীতের পর্যায়ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ তখন গ্রামরাগাদির সঙ্গে সঙ্গে জন্য জনক রীতিতে ভাষা, বিভাষা, অন্তরভাষা প্রভৃতি অভিজাত দেশীরাগের বিকাশ হয়। ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিনীর বিকাশ হয় আরো পরবর্তীকালে। তখন রাগগুলি ঋতু অনুসারে গাওয়ার প্রথা ছিল। যেমন গ্রীষ্মে—দীপক, বর্ষায়— মেঘ, শরতে— ভৈরব, হেমস্তে—শ্র, শীতে— মালকোষ এবং বসস্তে- হিন্দোল। ( ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থে এই রাগনামগুলিতে কিঞ্চিত পার্থক্য লক্ষিত হয় )।
রাগ ছয়টির জন্য ছয়টি করে রাগিনী (ভার্যা ) ছিল (এ বিষয়েও মতপার্থক্য বিদ্যমান ) । সেই রাগ-রাগিনী পদ্ধতিই কালের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রচলিত থাট-রাগ পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়েছে অর্থাৎ বর্তমান রাগ সংগীতে ক্লাসিকাল যুগের সংগীতধারাই প্রবাহিত। কিন্তু তাই বলে কোনমতেই একে মার্গসংগীত আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ অত্যন্ত কঠোর সাংস্কৃতিক নিয়মাবদ্ধ সেই মাৰ্গসংগীত বৈদিক যুগেই লপ্ত হয়েছিল।
ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন হোল সংগীত। অতি প্রাচীনকাল থেকে এর গৌরবময় ঐতিহ্য বিরাজিত। যখন বিশ্বের কোন দেশ সাধারণ লোক সংগীতের স্তরেও পৌঁছাতে পারে নি, তখন থেকেই ভারতবর্ষে সংগীতকলার পরিপূর্ণ বিকাশ ছিল। ভারতীয় সংগীত ক্রমবিকাশের কাহিনী অত্যস্ত বৈচিত্র্যময়, এবং এর চর্চা শুধুমাত্র কলাবিষ্ঠার চর্চাই নয়, একটি জাতির মনীষা সম্পর্কেও জ্ঞানলাভ করা। যারা পৃথিবীকে তাল ও স্থর সমন্বিত এমন একটি বিদ্যা দান করেছেন।
স্বরাক্ষর পদ্ধতির (সা, রে, গ, ম প্রভৃতি) আবিষ্কার সর্বপ্রথম হয় ভারতবর্ষে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় খৃষ্টীয় ১ম শতাব্দীর নারদীশিক্ষাগ্রন্থে । পাশ্চাত্য সংগীতে যার বিকাশ হয় ১০ম শতাব্দীতে (পাশ্চাত্য সংগীত প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য)।
নাট্যশাস্ত্রকার বর্ণিত সাংগীতিক উপাদানাদি তথ। বাঘযন্ত্রাদির শ্রেণীবিভাগ ( তত, সুষির, অবনদ্ধ ও ঘন— যথাক্রমে Chordophones, Aerophones, Membranophones & Autophones ) প্রভৃতি অত্যস্ত বিজ্ঞানসম্মত হিসাবে বিশ্বের সর্বত্র স্বীকৃতিলাভ করেছে।
প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতের প্রধান সহগামী যন্ত্র ছিল বীণা, যার মধ্য যড় জ ‘আধার ষড়‚জ’ হিসাবে স্বীকৃত ছিল। অবশ্য তার সঠিক রূপ (pitch/ vibration) নিরূপণ করা আজ কঠিন। কারণ বীণার দৈর্ঘ্য প্রভৃতির উপরে তা নির্ভরশীল ছিল। তবে আধার যড় জকে কেন্দ্র করেই সর্বদা সামগান লীলায়িত ছিল এমন কথা মনে করা অনুচিত, কারণ ক্রমশ তা মধ্যম, পঞ্চম, আদি স্বরগ্রামে উত্থিত হোত। যে রীতি ঋগ্বেদ মন্ত্রাদি উচ্চারণে আজও অনুম্বত হতে দেখা যায়।
মধ্যযুগের প্রারম্ভে বিদেশী আক্রমণের সেই দুর্যোগের দিনে ললিতকলাবিদ্যার চর্চা অনেক হ্রাস পায়। তবে ভারতীয় সংস্কৃতি তার গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে চিরকালই বিরাজিত, যার প্রমাণ তৎকালীন সঙ্গীতfচার্যদের সাধনা ও সৃষ্টি থেকে পাওয়া যায়। (সংগীতজ্ঞদের জীবনকথা দ্রষ্টব্য)।
আলাউদ্দীন খিলজির রাজত্বকালে (১৩শ-১৪শ শতাব্দী) সর্ব প্রথম হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের স্থত্রপাত হয়েছিল বলা যায়। হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটক সংগীতের সংজ্ঞা সর্বপ্রথম হরিপাল রচিত সংগীত সুধাকর ( ১৩০৯-১৩১২ খৃষ্টাব্দে রচিত ) গ্রন্থে পাওয়া যায়। ইতিপূর্বেই আরব ও পারসিক প্রভাবে উত্তর ভারতীয় সংগীত ও সংস্কৃতিতে নান। বিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল। উত্তর ভারতীয় সংগীতের বিবর্তনের পর থেকেই শুধু দক্ষিণী সংগীতকে কর্ণাটক বলা আরম্ভ হয় [ P. Sambomoorthy History of Indian Music. 1980 ]।
হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের গোড়াপত্তন করেন অতিগুণী ও স্রষ্টা আমীর খসরু । ধ্রুপদগানের সৃষ্টি নাকি তৎকালীন বৈজুবাওরা নামক এক সঙ্গীতগুণীর দ্বারা হয়েছিল । ( এই বৈজু বাদশাহ আকবরের সময়ের বৈজু নয়) [ এবারেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী : হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের স্থান। ১৩৬৪ ]। ১ অবশ্য এ বিষয়ে মতভেদ আছে, কারণ কেহ-কেহ রাজা মানকে (১৪৮৬-১৫১৬ খৃষ্টাব্দ) ধ্রুপদের স্রষ্টা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আবার কারো মতে বৈদিক যুগ থেকেই ধ্রুপদ প্রচলিত। যাই হোক উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় সংগীতের বিবর্তন আরম্ভ হয় মুসলমান আগমনের পরে।
১৪শ শতকে আমীর খসরু খেয়াল, কাওয়ালি, গজল প্রভৃতি গীতরীতির প্রবর্তন করেন। ১৫শ শতকে জৌনপুরের নবাব স্থলতান হুসেন শর্কী খেয়াল গানের আরো উন্নতি বিধান করেন। গোড়ার দিকে খেয়াল ছিল কিঞ্চিত নিয়মভঙ্গ ধ্রুপদের মতো। ক্রমে নানা তান, অলংকারাদির প্রয়োগসহ ছোটো ও বড়ো দুই প্রকার খেয়ালের বিকাশ হয়। এর চরম উৎকর্ষসাধন করেন তানসেন বংশীয় ন্যামৎ খঁ। ( সদারঙ্গ)। খেয়ালের যাবতীয় বিবর্তন দিল্লীতেই হয়, এই সংগীতধারার বাহকদের বলা হোত কব্বাল ঘরাণা। কব্বাল বংশের গোলাম রস্থল খেয়ালের যথেষ্ট উন্নতি বিধান করেন, এবং তিনি স্বয়ং অতিগুণী শিল্পী ছিলেন (ক)। তাঁর পুত্র গোলাম নবী (শোরী মিঞা ) ‘টপ্পা’ গীতরীতির প্রবর্তন করেন।
বাংলাদেশে টপ্পা গানের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য। গোলাম রস্থলের দৌহিত্র শঙ্কর ও মধু খন খেয়ালীয়া হিসাবে সংগীত জগতে প্রসিদ্ধ। গোয়ালিয়রবাসী নখন পীরবক্স ধ্রুপদী বংশীয় হলেও সদারঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং খেয়াল গাইতেন। নখন পীরবকৃসের পৌত্র হদ্দ, খাঁ, হস্থ্য খঁ। ও নথ, খ। বিখ্যাত খেয়ালীয়া ছিলেন। এঁদের তিনটি ঘরাণা থেকেই থেয়াল গীতরীতির শ্রেষ্ঠ বিকাশ হয়েছে।
ঠুংত্রী হোল খেয়াল গানের রাগ ও রীতিভ্রষ্ট একপ্রকার চটুল গীতরীতি। সর্বপ্রথম এর প্রচলন হয় বারাণসীতে। গ্রাম্য গীতি থেকেই নাকি এর বিকাশ। তবে বর্তমান বারাণসী ঘরাণার প্রধান প্রচারক ছিলেন ঠুংরী সম্রাট মৈজুদ্দীন খা। লক্ষ্ণৌতে ঠুংত্রীর প্রচারক হলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। পাঞ্জাবী ঠুংরী সম্ভবত এগুলির মিশ্রণে সৃষ্ট। তবে পাঞ্জাবী ঠুংরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হোল কতকগুলি স্থানীয় অলংকার প্রয়োগ। হিন্দুস্থানী সংগীতের প্রধান চারটি ধারা হোল—ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুত্রী।
২০শ শতাব্দীতে ধ্রুপদ ও টপ্প। গানের শিল্পী অপেক্ষাকৃত কমে গেছে। তবে খেয়াল ও ঠুংরী গান বিভিন্ন গুণীর মাধ্যমে নব নব রূপে বিকাশলাভ করেছে। এ ছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে শাখা বহুল অসংখ্য আঞ্চলিক ও জাতীয় সংগীতের প্রচলন আছে। যেমন, ভাঙড়া, হীড়; রাজস্থানের মাণ্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের চৈতী, সাবণী, লাবণী, বিরহা, কজরী; আসামের বনগীত, বিহুগীত; বাংলার কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালী প্রভৃতি। যার পূর্ণ বিবরণের জন্য একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থের আবশ্যক ।
তবে কিছু কিছু পরিচয় “গীতরীতি প্রসঙ্গ” পরিচ্ছদে দেওয়া হয়েছে । আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত হিসাবে বাংলার রবীন্দ্রসংগীত স্বীকৃত।
বর্তমান সময় প্রচলিত সঙ্গীত:
সময়ের সাথে সাথে সঙ্গীতের বিভিন্ন নতুন নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। কণ্ঠসঙ্গীতে নতুন যুগের সুরকার, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী নতুন সঙ্গীত রীতি সৃষ্টি করেছেন। যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরাও পিছিয়ে থাকেন নি। আমরা আমাদের সাইটে এই সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো। আপনারা লিংক গুলোতে ক্লিক করে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
নতুন নতুন আর্টিকেল প্রতিনিয়ত যুক্ত হবে। আপডেট পেতে নিয়মিত ভিজিট করুন।