Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

সদারঙ্গ [ Sadarang ] ওস্তাদ নিয়ামত খা

সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) আনুমানিক ১৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে সদারঙ্গের জন্ম হয়। বিশেষ ঐতিহ্যপূর্ণ সংগীতশিল্পীর বংশজাত সদারঙ্গের আসল নাম নিয়ামত খা। তিনি সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেনের কন্যা বংশের দশম পুরুষ ছিলেন। তাঁর পিতার নাম লাল সানি এবং পিতামহের নাম খুশহাল খাঁ। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন প্রসিদ্ধ বীণাশিল্পী।

মোহাম্মদ শাহ ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ সংগীতপ্রেমিক ও তৎকালীন সময়ের কুশলী কলাবিদ। তাঁর রাজদরবারের সভাগায়ক ওস্তাদ নিয়ামত খা ছিলেন সুদক্ষ বীণাশিল্পী, উচ্চমানের গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। অজস্র খেয়াল, ধ্রুপদ ও ধামার গান রচনা করে সংগীতভুবনে তিনি একজন কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে আছেন। তাঁর সময়েই ধামার গান বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেক সংগীত-গবেষকের মতে, তিনিই ‘কলাবন্ত খেয়ালে’র জন্মদাতা। কথিত আছে, সদারঙ্গ সোয়া লক্ষ খেয়াল গান রচনা করেছিলেন এবং খেয়াল গানেই তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। খেয়াল গানের প্রবর্তক হলেও এই শ্রেণির গান শেখার ব্যাপারে নিজ আত্মীয়-পরিজনদের তিনি কখনোই উৎসাহিত করেননি।

সদারঙ্গ তাঁর সৃষ্ট খেয়াল গানে মোহাম্মদ শাহের স্তুতিস্বরূপ ‘মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলে’ কথাটি উল্লেখ করে মহামতি বাদশাহকে স্মরণীয় করে গেছেন। নিজের রচিত পদসমূহের মুখবন্ধে তিনি সদারঙ্গিলে মোহাম্মদ শাহ লিখতেন। মোহাম্মদ শাহ ১৭১৯ থেকে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লিতে রাজত্ব করেন। মারাঠা আক্রমণের ফলে তাঁর রাজ্যে অন্তর্বিদ্রোহ দেখা দেয়। তাঁর রাজত্বকালে পেশোয়া বাজিরাও এবং নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন।

ডকুমেন্টরি:

 

রাজ্যশাসনে পটু না হলেও মোহাম্মদ শাহের রাজত্বকাল সংগীতকলার শ্রীবৃদ্ধির জন্য প্রসিদ্ধ । তাঁর দরবারের অন্যতম সভারত্ন ও কুশলী বীণাশিল্পী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ মোহাম্মদ শাহ নামটি সংগীতজগতে অমর করে রেখেছেন। একবার দিল্লি অধিপতি সম্রাট মোহাম্মদ শাহ ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, বীণার সঙ্গে সারেঙ্গির সংগত হবে। মহামান্য সম্রাটের উজির নিয়ামত খাঁকে বাদশাহর এই ইচ্ছার কথা জানালে তিনি অসম্মত হন। কারণ তাতে বীণাশিল্পীদের সম্মান ক্ষুণ্ন হবে। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বাদশাহ নামদার ওস্তাদ নিয়ামত খাঁকে দরবার থেকে বহিষ্কার করেন। তখন নিয়ামত খাঁ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হন।

ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যায়, শাস্ত্রকার সংগীতজ্ঞ হজরত আমির খসরু খেয়াল গানের রচনারীতি প্রবর্তন করেছিলেন। এরপর সুলতান হুসেন শাহ্ শর্কি, রাজবাহাদুর চঞ্চল সেন, চাঁদ খাঁ, সুরজ খাঁ প্রমুখ কলাবিদ খেয়াল রচনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা কেউই সাফল্য লাভ করতে পারেননি।

সংগীতজ্ঞ নিয়ামত খাঁ এর কারণ অনুসন্ধান করে বুঝলেন, বাদশাহর নাম খেয়ালের পদে যুক্ত করা না হলে খেয়াল গান সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করবে না এবং জনপ্রিয় হতে পারবে না। কেননা পূর্ববর্তী কবিরা তাঁদের সংগীতে নিজেদের উপনাম যুক্ত করার কারণে বাদশাহ নামদার সেই গানের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করতেন না, ফলে এর প্রচারও হতো না।

ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ যখন তাঁর রচিত খেয়াল গানের চরণে বাদশাহর নাম যুক্ত করে ‘সদারঙ্গিলে মোহাম্মদ শাহ্’ করেন তখন বাদশাহ নামদার আগ্রহ বোধ করেন এবং খেয়াল গানের প্রসার ও প্রচার সহজতর হয়ে যায়। এজন্য নিয়ামত খাঁ শিষ্যদের খেয়াল গানে বিশেষভাবে তালিম দিয়ে দক্ষ করে তোলেন এবং তাদের নিয়ে দিল্লিতে উপস্থিত হন।

যোগ্য ওস্তাদের উপযুক্ত শিষ্যরা সুযোগমতো একদিন বাদশাহ নামদারের দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে গান শোনান। গানের মধ্যে নিজের নাম শুনে বাদশাহর আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি প্রশ্ন করে জানতে পারেন এই গানের রচয়িতা ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ, যাঁর উপনাম সদারঙ্গিলে। বাদশাহ নিয়ামত খাঁকে দরবারে ডেকে পাঠান এবং তাঁর পূর্ব অপরাধ ক্ষমা করে দেন। ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ দিল্লির সম্রাট মোহাম্মদ শাহর পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হন।

সদারঙ্গের খেয়াল বিশেষভাবে শৃঙ্গার রসপ্রধান ও বাদশাহ নামদারের প্রশস্তিমূলক। ধ্রুপদী গায়করা এই নতুন খেয়ালকে ‘স্ত্রী লোকের গীত’ বলে উপহাস করতে লাগলেন। দরবারের গায়িকারা বাদশাহর কাছে এই নতুন গানের তালিম নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মোহাম্মদ শাহ তাতে সম্মতি প্রদান করেন। ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ পুনরায় বাদশাহর বিরাগভাজন হতে সাহসী না হয়ে আত্মসম্মান রক্ষার জন্য এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য হসনঘাটির ওপর দরবারি গায়িকাদের শিক্ষার ভার দেন।

ঐতিহাসিক ভিত্তিতে জানা যায় যে, সদারঙ্গ নিজেও কোনো জলসায় স্বরচিত এই খেয়াল গাইতেন না। ক্রমে খেয়াল গানের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ মনোভাব কেটে যায় এবং খেয়াল হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। তখন অনেকেই খেয়াল গান রচনা করে তাতে সদারঙ্গের নাম জুড়ে দেওয়া শুরু করে। সদারঙ্গের সঙ্গে তাঁর পুত্র ওস্তাদ ফিরোজ খা ওরফে অদারঙ্গর নাম বর্তমানে একত্রে উচ্চারিত হয়। মহাপ্রতিভাবান পিতা ওস্তাদ নিয়ামত খাঁর সঙ্গে সুযোগ্য পুত্র ওস্তাদ ফিরোজ খার নামও সংগীতজগতে সদারঙ্গ-অদারঙ্গ নামে অমর হয়ে আছে।

Exit mobile version