সাদরা (সঙ্গীত ধারা)

সাদরা হলো হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠসঙ্গীত ধারা, যা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছে। যদিও এটি আধুনিক সময়ের শাস্ত্রীয় ধারার মধ্যে যেমন খেয়াল বা ধ্রুপদের মতো প্রচলিত নয়, তবুও সাদরা তার অনন্য তালবদ্ধতা ও সুরের কারণে সঙ্গীত ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

সাদরা মূলত একটি কণ্ঠসঙ্গীত শৈলী, যেখানে গানের রচনাগুলো নির্দিষ্ট তাল বা তালবদ্ধ ছন্দে পরিবেশন করা হয়। অন্যান্য শৈলীর মতো এখানে তালের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বচ্ছতা থাকে এবং সঙ্গীতস্রষ্টা নির্দিষ্ট নির্ধারিত তাল নির্বাচন করেন।

সাদরার প্রধান তালগুলি হল:

  • তীব্র তাল (মাত্রা): সাত মাত্রার একটি তাল, যা চমকপ্রদ এবং জটিল ছন্দের জন্য পরিচিত।
  • সূল তাল (১০ মাত্রা): দশ মাত্রার তাল, যেখানে তালের ছন্দময় ভারসাম্য বজায় থাকে।
  • চৌ তাল (১২ মাত্রা): বার মাত্রার তাল, যা হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে বহুল ব্যবহৃত।
  • ঝপতাল (১০ মাত্রা): একটি দশ মাত্রার তাল, যা ২+৩+২+৩ ভাগে বিভক্ত এবং অনেকাংশে জনপ্রিয় ও বহুমুখী।

এই তালগুলির মাধ্যমে সাদরার গান সুনিপুণ ও নিয়ন্ত্রিত ছন্দে পরিবেশন করা হয়।

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন

সাদরার ইতিহাস বহু শতাব্দী পুরনো, এবং এটি উত্তর ভারতের রাজকীয় সভা ও সঙ্গীত কেন্দ্রে প্রসারিত হয়েছিল। এটি ধ্রুপদ ও খেয়ালের সঙ্গে পাশাপাশি বিকশিত হলেও তার নিজস্ব একটি সুনির্দিষ্ট শৈলী ছিল, যা নির্দিষ্ট তালবদ্ধ গীতরচনায় ফুটে উঠত।

সাদরা মূলত ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক কাব্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। গানগুলোতে প্রেম, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক ভাব ফুটে উঠত। মধ্যযুগীয় রাজপ্রাসাদে এর প্রচলন ছিল প্রবল এবং সেখানে তালমেলার গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল।

 

সঙ্গীত কাঠামো ও পরিবেশন

সাদরা পরিবেশনার শুরু হয় রাগের ধীর গয়ন থেকে, যাতে রাগের স্বরবিন্যাস ও আবেগ স্থাপন হয়। এরপর নির্দিষ্ট তাল অনুসারে গান শুরু হয়। গায়করা তালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ লয়করি (ছন্দসঙ্গতি) এবং বোল (স্বরের ধ্বনি) ব্যবহার করে গানকে সুসংগঠিত করে।

খেয়ালের তুলনায় সাদরা বেশি নিয়ন্ত্রিত এবং তালানুযায়ী সঙ্গীত পরিবেশনে দৃঢ়। এই ধারা গানের কথায় বেশি গুরুত্ব দেয়, যাতে আধ্যাত্মিক ও কবিতার গভীরতা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছায়।

সাদরায় গানের মূল স্তবক বারংবার গাওয়া হয়, যা শ্রোতাদের মধ্যে ভাবপ্রবণতা সৃষ্টি করে।

 

আধুনিক সময় ও প্রাসঙ্গিকতা

আজকের দিনে সাদরা তুলনামূলক কম পরিবেশিত হলেও, এটি হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। অনেক আধুনিক শাস্ত্রীয় গায়ক ও শিক্ষক সাদরার তাল ও গায়নের নিয়মাবলী শেখান, কারণ এটি সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের তাল নিয়ন্ত্রণরচনাবদ্ধ সঙ্গীতের শৃঙ্খলা শেখার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

বিশেষজ্ঞরা সাদরাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চেষ্টা করছেন, যাতে নতুন প্রজন্ম এই শৈলীর সৌন্দর্য ও সঙ্গীতরীতি অনুধাবন করতে পারে।

 

সাদরা হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই বিশেষ শৈলী যা তালবদ্ধ ছন্দ ও গানের মধ্য দিয়ে শিল্পীর কণ্ঠের শৃঙ্খলিত দক্ষতা ও আবেগের সুনিপুণ প্রকাশ ঘটায়। তীব্র, সূল, চৌ ও ঝপতালের মতো নির্দিষ্ট তালবদ্ধতা এটিকে অন্যান্য ধারার থেকে আলাদা করে তোলে। যদিও আধুনিক সময়ে এর চর্চা কমে গিয়েছে, তবুও সাদরার ঐতিহ্য ও শৈলী আজও সঙ্গীতবিশ্বে একটি গৌরবময় অংশ হিসেবে বিবেচিত।