স্বামী হরিদাস : সুরসম্রাট মিয়া তানসেনের সংগীতগুরু স্বামী হরিদাসের অতন্দ্র প্রহরায় উত্তর ভারতীয় সংগীত অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তাই এই বিদগ্ধ সংগীতগুণীজনকে বলা হয় ভারতীয় সংগীতের পরিত্রাতা। গতানুগতিক ধর্মাশ্রয়ী সংগীতকে তিনিই নতুনভাবে সজ্জিত করে জনসমাজে প্রচলন ও প্রসারিত করেন। তাঁর সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার গায়নশৈলী এক নতুন রূপ ধারণ করে তৎকালীন সংগীতভুবনকে এগিয়ে নিয়ে যায় আলোকময় পথে।
স্বামী হরিদাস
উত্তর প্রদেশের আলিগড় জেলার একটি গ্রামে স্বামী হরিদাস জন্মগ্রহণ করেন। ভক্তসিন্ধু গ্রন্থে তাঁর জন্ম ১৪৪১ খ্রিষ্টাব্দে উল্লেখ রয়েছে। কোনো কোনো সংগীত-গবেষক ও সংগীতজ্ঞ বলেন, ১৪৩৭ খ্রিষ্টাব্দ হরিদাসের জন্মের বছর। আবার কারো কারো মতে ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল স্বামী আশুধীর এবং মাতার নাম গঙ্গা। আশুধীর মুলতান জেলার উচ্চশ্রেণির সারস্বত ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিশেষ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন।
তবে স্বামী হরিদাসের জন্মদাতার নাম স্বামী আশুধীর কি না সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন। তাঁদের মতে, হরিদাস ছিলেন ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ এবং আশুধীর সারস্বত ব্রাহ্মণ। সুতরাং তাঁদের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয়। তাই পুত্র নয়, বরং পুত্রসম ছিলেন বলাই হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু বেশিরভাগ সংগীত-গবেষক এবং গুণীজন প্রথম মতটিকেই বহুলাংশে সমর্থন করে থাকেন।
সংগীতের সংস্কার করার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই যেন হরিদাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সাধক জীবনে সংগীত ক্রমে ক্রমে ঈশ্বর সাধনার পথে একটি প্রধান অবলম্বন হিসেবে পরিগণিত হয়। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি বৃন্দাবনে চলে যান এবং কৃষ্ণ ভজনায় মনপ্রাণ সমর্পণ করেন।
স্বামী হরিদাস ছিলেন নিঃস্বার্থ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং বৃন্দাবনে তাঁরই নামানুসারে ‘হরিদাসী সম্প্রদায়’ নামে একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। বৃন্দাবনের । বাঁকেবিহারির মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী হরিদাস নিধুবন নিকুঞ্জে একটি ছোট কুটিরে সাধন-ভজন করেই সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সে সময়ের আরো দু-একজন হরিদাসের নামও জানা যায়। সেজন্য স্বামী হরিদাসকে বলা হতো আসুকো হরিদাস’।
তিনি ব্রজভাষায় ধ্রুপদাঙ্গের কিছু কিছু পদ রচনা করেছেন। প্রত্যেকটি গানে রাগরূপকে তিনি অবিকৃত রেখে সুরারোপ করেছেন। এবং তালকে যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের যথাযথ প্রচারের জন্য তিনি যে শিষ্যমণ্ডলী তৈরি করেছিলেন, উত্তরকালে তাঁরা সকলেই সংগীতের জগতে একেকজন দিকপাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে মিয়া তানসেন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যদের মধ্যে রাজা শৌরসেন, দিবাকর পণ্ডিত, সোমনাথ পণ্ডিত, নায়ক রামদাস, নায়ক বৈজু বাওরা, নায়ক গোপাল লাল, নায়ক মদন রায় প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ধর্মপ্রচারের জন্য সুরারোপ করে নৃত্যসহযোগে তিনি বৃন্দাবনে যে রাসের পদ গানের প্রচলন করেন তাই বর্তমানকালের ব্রজধামের রাসলীলা। কেবল রাসলীলা নয়, হোলি গানেরও তিনি উন্নততর প্রবর্তক। একই সঙ্গে তিনি গীত, বাদ্য ও নৃত্যের যথেষ্ট উন্নতি বিধান করেছিলেন। তিনি ১৫০০ শতাব্দীর পরিবর্তিত ধ্রুব-প্রবন্ধাবলিকেই গ্রহণ করেন এবং ভগবানের গুণকীর্তনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছিলে
স্বামী হরিদাসজির নামে কয়েকটি গ্রন্থ পাওয়া যায়, তার মধ্যে হরিদাসজিকো গ্রন্থ, স্বামী হরিদাসজিকো পদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এই গ্রন্থগুলো তাঁর নামে অন্য কারো রচিত কি না তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। উত্তর ভারতীয় সংগীতের বিদগ্ধ অধিনায়ক ও ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বেশ কয়েকজন সংগীতজ্ঞ তৈরির মহান কারিগর স্বামী হরিদাস ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সুর স্বর্গালোকের উদ্দেশে মহাপ্রস্থান করেন।
আরও দেখুন: