Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

হযরত আমীর খসরু

হজরত আমীর খসরুর জীবনী [ Hazrat Amir Khusro] নিয়ে আজকের আলোচনা। উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের ইতিহাস পর্যালোচনায় যে কয়েকজন গুণী-সঙ্গীতবিদের পরিচয় আমরা পাই তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শস্থানীয় যাঁরা এবং যাঁদের অবদানে এই উপমহাদেশীয় সঙ্গীত সমৃদ্ধ, তাঁরা হলেন-হজরত আমীর খসরু সুলতান হোসেন শাহ সৰ্কী, মিয়া তানসেন, নিয়ামত খাঁ (সদারঙ্গ), স্বামী হরিদাস, যদুভট্ট ও পন্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে।

উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে এঁদের অবদান অপরিসীম ও অতুলনীয়। তাঁরা ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। তাই মরেও অমর হয়ে রয়েছেন এবং থাকবেনও চিরদিন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁরা যুগস্রষ্ঠা। তাঁদের সম্বন্ধে আমাদের জানা দরকার।

 

 

হযরত আমীর খসরু [ Hazrat Amir Khusro ]  :

উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের ইতিহাস পর্যালোচনায় যে কয়েকজন গুণী-সঙ্গীতবিদের পরিচয় আমরা পাই তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শস্থানীয় যাঁরা এবং যাঁদের অবদানে এই উপমহাদেশীয় সঙ্গীত সমৃদ্ধ, তাঁরা হলেন-হজরত আমীর খসরু সুলতান হোসেন শাহ সৰ্কী, মিয়া তানসেন, নিয়ামত খাঁ (সদারঙ্গ), স্বামী হরিদাস, যদুভট্ট ও পন্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে। উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে এঁদের অবদান অপরিসীম ও অতুলনীয়।

তাঁরা ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। তাই মরেও অমর হয়ে রয়েছেন এবং থাকবেনও চিরদিন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁরা যুগস্রষ্ঠা। তাঁদের সম্বন্ধে আমাদের জানা দরকার।

সে যুগের ভারতবর্ষে আমীর খসরুর ন্যায় বহু গুণসম্পন্ন ব্যক্তি খুব কমই ছিলেন। সুলতান ইলতুৎমিশ (আলতামাস)-এর রাজত্বকালে (১২১১-১২৩৬ খ্রীঃ) মধ্য এশিয়ার মোঙ্গল সেনাপতি চেঙ্গিস খাঁর উৎপীড়নে খসরুর পিতা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুলতান আলতামাস তাঁদের অভ্যর্থনা জানান এবং আশ্রয় দান করেন। খসরুর পূর্ব পুরুষগণ জাতিতে তুর্কী ছিলেন। খসরুর পিতা আমীর মুহম্মদ সৈফ-উদ্-দীন প্রথমে বলবন নিবাসী পরে ভারতে স্থায়ী নিবাসী (সঃ১৯৫৪, পৃঃ ৬–৭) হন। খসরুর মাতা সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের (১২৬৬-১২৮৬ খ্রীঃ) সমর সচিবের কন্যা।

আমীর খসরু, পারস্যের কবি নাকি ভারতের কবি এ সম্পর্কে আজও দ্বিমতের অবসান ঘটেনি। বহু প্রমাণ তাঁর বিদ্যমান। তবে অধিকাংশের মতে তিনি ভারতের পাতিয়ালায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম সন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন ১২৫৩ কেউ বলেন ১২৫৪ খ্রীষ্টাব্দ আবার কেউ বলেন ৬৫২ হিজরীতে তাঁর জন্ম।

আমীর খসরুর আসল নাম আবুল হাসান। কেহ বলেন আমীন উদ্দীন মুহম্মদ হাসান। ‘খসরু’ তাঁর ছদ্ম নাম বা কাব্যিক (Pen name) নাম। পরবর্তীকালে এই নামেই তিনি কবিতা রচনা করতেন। শোনা যায় সুলতান জালাল উদ্দীন খিলজী কর্তৃক তিনি ‘আমীর’ উপাধিতে ভূষিত হন। এ সম্পর্কেও দ্বিমত রয়েছে।

বাল্যকালে আমীর খসরু হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার শাগরেদ ছিলেন। উপযুক্ত বয়সে তিনি বলবনের দরবারে যান। বলবনের পুত্র মুহম্মদ তাঁকে বাক্য প্রতিভার জন্যে সম্মানের আসনে দরবারে রেখে দেন। ঐ সময় থেকে তিনি কাব্য ও সঙ্গীত চর্চায় বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন এবং কিছুকাল পরেই কাব্য ও সঙ্গীতে চরম পরাকাষ্ঠার পরিচয় দিতে সক্ষম হন।

সেই সময় রাজনীতির বহু ওলট-পালট (Topsyturvy) ঘটে। গুলাম বংশের পতনকাল হ’তে তোগলক বংশের আরম্ভকাল পর্যন্ত আমীর খসরু ১১ জন রাজা বা শাসন কর্তা দেখেছিলেন। খসরুকে শুধু কবি বা সঙ্গীতজ্ঞ বললে ভুল করা হবে। কেননা, একাধারে তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক, কবি, সঙ্গীতবিদ ও যোদ্ধা।

 

কবি ও সাহিত্যিক আমীর খসরু [ Poet and literary Amir Khusro ] :

খ্ৰীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে সম্রাট জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলঞ্জী যখন মুইজুদ্দীন মোহাম্মদ বিন সামের প্রতিষ্ঠিত বংশ উচ্ছেদ করে (Destroyed) দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ (Enthroned) করেন, তখন খসরুর কবি-প্রতিভার ঘুরণ (Shining) দেখা দেয়। খসরু আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃতি প্রভৃতি ভাষায় সুদক্ষ পণ্ডিত ছিলেন। যুগস্রষ্টা হিসেবে তাঁকে উর্দু ভাষার জনক বলা হতো।

শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর যুগ-চেতনার পরিচয় স্পষ্ট করে রেখেছেন। তিনি বহু কাব্য গ্রন্থ (Book of Verses) রচনা করেছেন। বাদশা আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে খসরু, হিন্দি ও ফার্সী ভাষায় এত বেশী কবিতা রচনা করেন, যা বিশাল পাঁচটি ভলিউমের থেকেও বেশী।

 

ঐতিহাসিক আমীর খসরু [ Historian Amir Khusro ] :

খসরু বিশেষ দক্ষতার সাথে সমসাময়িক ইতিহাসের উপাদানগুলো নিপুণতার সাথে কাজে লাগিয়েছিলেন। কবি হিসেবে কীর্তিত হলেও ঐতিহাসিক হিসেবেও তার অবদান কম নয়। বস্তুতপক্ষে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তার অবদান দক্ষতার সাথেই সংযোজন করেছেন। তার বিভিন্ন কর্মেই ইসলামী সংস্কৃতির (Muslim culture) পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। মোট কথা ঐতিহ্যের (Traditional) উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি বিভিন্ন ধারার সমন্বয় সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

যোদ্ধা আমীর খসরু [ Warrior Amir Khusro ] :

খসরু, তাঁর কয়েকজন সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা (Patronization) লাভ করেছিলেন। সভাসদ হিসেবে তিনি শুধু সঙ্গীতজ্ঞ বা কবি-সাহিত্যিকই ছিলেন না, সুলতানদের রাজকীয় জরুরী অবস্থায় প্রয়োজনবোধে সময় সময় তিনি তরবারীও ধারণ করতেন। বহুমুখী প্রতিভাই তাকে অনুমান ১২ বছর থেকে শেষ পর্যন্ত দিল্লীর সম্রাটদের বিশেষ সম্মানের পাত্রে পরিণত করেছিলো।

 

 

সঙ্গীতজ্ঞ আমীর খসরু [ Musicologist Amir Khusro ] :

বলবনের মৃত্যুর পর খিলজী বংশের সুলতান জালাল উদ্দীন খিলজীর রাজত্বকালে ইসলামী ভাবধারা সম্পৃক্ত ও হিন্দুয়ানী ভাবধারাসম্পন্ন সঙ্গীতের বিশেষ মিশ্রণের আভাস পাওয়া যায়। বিশেষ বলছি এ জন্যে যে এরও বহু শতাব্দী আগে মুহম্মদ বিন কাসিমের আগমনকাল থেকেই আরব বণিকদের (Trader) উপনিবেশ স্থাপিত হয় এবং এই উপনিবেশ সমূহের কল্যাণে সে যুগের ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচারের কাজে বহু দরবেশ, আউলিয়া ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তির আগমন ঘটে।

‘ভারতের সংস্কৃতি, নামক গ্রন্থে ডক্টর তারাচীদ মহাশয় লিখেছেন ‘সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের অভ্যুদয়ের পর থেকেই ভারতে ইসলামের যোগাযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়।’ জালাল উদ্দীন খিলজীর পরে বাদশাহ আলাউদ্দীন খিলজীর (১২৯৬-১৩১৬ খ্রীঃ) আমলে বিশেষ করে মুসলিম ও হিন্দু: (ভারতীয় সঙ্গীতের উৎকর্ষ সাধিত হয় সঙ্গীতবিদ খসরু কর্তৃক। হযরত খসরুই ছিলেন সে যুগের মুসলিম মনীষী। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার (versatile or manitold genious) অধিকারী।

উপমহাদেশীয় হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক মিলন সাধনে (adjustment) খসরু ছিলেন বিশেষ যত্নবান ও আগ্রহী এবং স্বয়ং এ বিষয়ে বিভিন্ন দিকে বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে আরব্য-পারস্য ধারার সংমিশ্রণে উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের এক অভিনব ধারা (New method or system of singing manner in music) ও নব-যুগ (New era) সৃষ্টি ও প্রবর্তন (introduce) করেন। বরণী বিরচিত ‘তারিখ-ই ফিরুজশাহী নামক গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থকারের (করম ইমাম, ফকীবুল্লা) বর্ণনায় আমীর খসরুর বিভিন্ন প্রতিভার উল্লেখ পাওয়া যায়।

সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় আমীর খসরুর বিজয়-কাহিনী সম্পৰ্কীত ঘটনাটি কিংবদন্তী হলেও তাঁর জীবন কাহিনীর সাথে অঙ্গীভূত। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি সঙ্গীত কীর্তিত (glorified) হন। ঘটনাটি ছিলো দারুন কৌতুহলী ও সমস্যাপূর্ণ। অর্থাৎ যিনি হারবেন তাঁর যন্ত্রটি বিজয়ীর হাতে তুলে দিতে হবে।

চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৩১১ খ্রীঃ) বাদশাহ আলাউদ্দিন খিলজীর প্রধান সেনাপতি মালিক কাফুর কর্তৃক দাক্ষিণাত্য বিজয় শেষ হওয়ার পর দেবগিরির রাজা রামদেবরাও যাদব দরবারে নায়ক গোপাল নামক জনৈক গায়ক বাদশাহের দরবারের প্রখ্যাত সঙ্গীতবিদ আমীর খসরুকে এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানান। গায়ক নায়ক গোপাল সম্বন্ধে শোনা যায়-‘কর্ণাটকী ও উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতি অর্থাৎ উভয় পদ্ধতি তাঁর আয়ত্বে ছিলো।

তাঁর গীত-পদ্ধতিকে বলা হতো “যুগলবন্দ খণ্ডগীতি, ছন্দ-প্রবন্ধ বা প্রবন্ধ গীতি।” আরও শোনা যায় তাঁর বার শত শিষ্য ছিলো যারা তাঁর পাকি (Palan quin) পর্যায়ক্রমে (by turns) বহন করতো।

কথিত আছে সপ্তাহকাল সিংহাসনের আড়ালে লুকিয়ে থেকে, নায়ক গোপালের গান শোনার পর ‘সামাত ও নিয়াজ’ নামক দুই প্রধান শাগরেদসহ আমীর খসরু সভায় উপস্থিত হন। তিনি প্রথমে ছন্দ, মনু, গীত্, সূত, মিশুতে ফার্সী ও হিন্দি ভাষায় গেয়ে শুনান। পরে স্বরচিত কবিতা ও পারস্য ও আরব্য কওল, কলুবানা, নকস্ নিগার, শুল্, হাওয়া, বসিত, ভিল্লান ও তারানা প্রভৃতি মুসলিম ঠাট গেয়ে সভাস্থ সকল শ্রোতাকে মুগ্ধ করেন।

পূর্ব শর্ত বা বাজি (Bet) অনুসারে হেরে গিয়ে নায়ক গোপাল নিজ হাতের যন্ত্রটি বিজয়ী আমীর খসরুর হাতে তুলে দিয়ে দুঃখের সাথে দরবার ছেড়ে চলে যান। এই দু’জন গুণী সম্পর্কে বহু কিংবদন্তী আছে- পাঠ্য পুস্তকের কলেবরে বৃদ্ধির ভয়ে তা আলোচনা করা হলো না।

 

গীতিকার আমীর খসরু [ Lyricist Amir Khusro ]:

কবিতাদি ছাড়াও গীত (গান) রচনাতেও তাঁর দক্ষতা ছিলো অসাধারণ। আল্লাহ্, নবী, পীর আউলিয়ার প্রশস্তিসূচক (Eulogistic, praise) এবং ধর্মীয় গূঢ় তত্ত্ব (abstruse) বিষয় কেন্দ্র করে তিনি বহু খেয়াল, ভজন (Song in praise of Allah) ও মরমী (mystic) গান বিভিন্ন রাগে ও তালে রচনা করেছেন।

 

রাগ স্রস্টা আমীর খসরু [ Raga Creator Amir Khusro ]:

সে যুগে আমীর খসরু ছিলেন অতুলনীয় সঙ্গীতবিদ। উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে তাঁর অবদান (noble deed or contribution) অপরিসীম (unlimited)। ভারতের পাতিয়ালা রাজ্যে জন্ম গ্রহণ করে বিভিন্ন ভাষা ও বিদ্যায় কোথেকে এবং কি ভাবে এই অসামান্য পারদর্শিতা (Extraordinary experience) অর্জন করেন সঠিকভাবে কোনো সূত্রে তা জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি ইতিহাসে স্বীকার্য যে তিনি ইরানী, ফাসী, আরবী, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত এবং সঙ্গীতেও ছিলেন বিশেষ নিপুণ (ingenious)।

বাদশাহ আলাউদ্দীনের দরবারে থাকাকালে তৎকালীন প্রচলিত ভারতীয় রাগ-রাগিণী গুলো আয়ত্ত্ব করে আরব্য-পারসিক মুকাম-গুস্বার অর্থাৎ মুসলিম রাগ-রাগিণীর সৃষ্টি ও প্রবর্তন (Invented and introduced) করেন। তাঁর রচিত রাগগুলোর মধ্যে বর্তমান প্রচলিত প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় রাগ ‘ইয়ামন (ইমন), জয়জয়ন্তী ও কাফি’ বিশেষ করেই উল্লেখযোগ্য।।

এছাড়া অল্প প্রচলিত রাগ খিলফ, সরপরা, সাজগিরি, গারা, শাহানা ইত্যাদি এবং লুপ্ত রাগ মুজীর, ফরগনা, ফিরোদাস্ত, বাখরেজ, সনাম্, ঘনাম্ মুয়াফিক্, উশশাক্ প্রভৃতি আমীর খসরুর রচনা ও প্রবর্তিত রাগ বলে জানা যায়।

 

তাল স্রষ্টা আমীর খসরু [ Taal or Tala Creator Amir Khusro ] :

সঙ্গীতে রাগ-রাগিণী ছাড়া তার-এর ক্ষেত্রেও আমীর খসরুর অবদান কম নয়। তাঁর রচিত ও প্রবর্তিত তালগুলোর মধ্যে জাবেদ, জনানী, দাস্তান, কৈদ, পটতাল, চ’পক, পাহলওয়ান, ফিরুদাস্ত (বর্তমানে অপ্রচলতি), অল্প প্রচলিত তাল-কাওয়ালী খামশা ও সওয়ারী এবং বর্তমানে বেশী প্রচলিত ত্রিতাল (তিন তাল), দ্রুত-একতাল, যৎ, চৌতাল, আড়াচৌতাল, ঝুম্রা (সুলতাল বা সুরফাঁক), পুশৃতো (পশতু) প্রভৃতি তালের নাম উল্লেখযোগ্য (মআদনুল মৌসীক)।

 

আবিষ্কারক ও প্রবর্তক আমীর খসরু [ Intentor Amir Khusro ]:

যন্ত্র : (১) বর্তমান প্রসিদ্ধ ও অধিক প্রচলিত সিতার (সেতার) যন্ত্রে তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও যন্ত্রটির আদি আবিষ্কারক ও প্রবর্তক আমীর খসরু। ইহা সর্ব সম্মত। (২) স্বরূপ ও গঠন (Form, shape) এবং সাজ-এর (equipage outfit) পরিবর্তন (change, reform) ঘটলেও বর্তমান তাল-বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে প্রসিদ্ধ যন্ত্র তবলার আবিষ্কারক ও প্রবর্তক আমীর খসরুকেই মানা হয়। (৩) পাকিস্তানের হালুকা গীতাদি (light song) এবং গজল ও কাওয়ালী গানের সাথে সঙ্গীতোপোযোগী প্রসিদ্ধ তালবাদ্যযন্ত্র ঢোলকের প্রবর্তকও আমীর খসরু।

 

 

একাধিক গীত-রীতি প্রবর্তক আমীর খসরু [ Multiple Singing Style & Genre Creator Amir Khusro ] :

(১) খেয়াল-রীতিঃ এই রীতি বা পদ্ধতির স্রষ্টা ও প্রর্বতক আমীর খসরুকে মানা হলেও খেয়াল গায়কী পদ্ধতি (Singing manner style) প্রচলন করেন জৌনপুরের সুলতান হোসেন শাহ সৰ্কী। পরে খেয়াল অঙ্গের উৎকর্ষতা বেশী সাধিত হয় ও জনপ্রিয়তা লাভ করে নিয়ামত খাঁ বা সদারঙ্গ কর্তৃক। বর্তমান খেয়াল রীতির আদি উৎস যে আমীর খসরু তা সর্বজন ও ইতিহাস স্বীকৃত।

তখনকার দিনে আমীর খসরু চারজন পাঠান বালককে তাঁর নিজস্ব পদ্ধতির সঙ্গীত শিক্ষা দান করেন। উক্ত চার খান্দান থেকে বংশ ও শিষ্যপরস্পর (succession of descent and teaching lineage) আমীর খসরু প্রবর্তিত সঙ্গীত-ধারা বিশেষ করে খেয়াল, তারানা ও কাওয়ালী সঙ্গীত-ধারা আজও বিদ্যমান।

ঐতিহাসিক প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়ঃ— খেয়াল গায়কদের মধ্যে রীমে দরবারের বড়ে মুহম্মদ খাঁ, উদয়পুরের মিয়াঁ বখসজী, আবদুল্লা খাঁজী এবং ইমাম বখসব্জী ও মিঠু খাঁজী ছিলেন তৎকালের প্রধান গুণী। এঁরা সকলেই উক্ত চার পাঠান খান্দানের বংশধর। বড়ে মুহম্মদ খাঁর চার পুত্র-রামপুর দরবারের বাকর আলি খাঁ, জয়পুর দরবারের মুবারক আলি খাঁ এবং আনান আলি খাঁ ও মুনওয়ার আলি খাঁ তৎকালের প্রসিদ্ধ গায়ক ছিলেন।

পরবর্তীকালের সঙ্গীত সম্রাট আল্লাদিয়া খাঁ সাহেবও এই খানদানের গায়কী পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন।

বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময়ের গ্রন্থকার ফকীরুল্লাহ বলেছেন যে, তখনকার গায়কদের মধ্যে দৌলৎ অফজুও নৌহারের সৈয়দ খাঁ ছিলেন আমীর খসরুর তালিম প্রাপ্ত।

(২) কাওয়ালী-রীতিঃ  বর্তমানে কাওয়ালী সঙ্গীত-ধারার উৎসমূলও আমীর খসরু। তিনি সামাত ও নিয়াজ নামক তাঁর দুই প্রধান সাগরেদ-এর মাধ্যমে কাওয়ালী পদ্ধতি প্রবর্তন ও প্রচলন করেন।

(৩) তারানা-রীতিঃ পারস্যের এক প্রকার গীত-রীতি ‘তারানার’ প্রবর্তকও আমীর খসরু। আমীর খসরু অত্যন্ত খোদাভক্ত ছিলেন।

‘সামা’-র প্রবর্তক বলে আমীর খসরুকে মানা না হলেও তিনি বহু সামা গান রচনা করেছিলেন। এজন্যে তাঁকে ‘মরমী কবি’ বলা হতো। তিনি ছিলেন হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার প্রধান ভক্ত ও মুরিদ। সদাসর্বদাই তিনি তাঁর পীর হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সামার মজলিশে যোগদান করতেন এবং স্বরচিত সামা গান গেয়ে হজরতকে খুশী করতেন। আমীর খসরু ১৩২৫ খ্রীষ্টাব্দে (সঃ) ১৯৫৪, পৃঃ ৬–৭) ইন্তেকাল করেন। সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ ‘নায়ক’ অভিধা তিনিই পেয়েছিলেন, যা তানসেনও পেয়ে যাননি (রাঃ দঃ)।

 

সূত্র : প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি – ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন

ভারতীয় (পাক-ভারত) সঙ্গীতের যুগ বিষয়ক ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিন এর অন্যান্য লিখনি ::

Exit mobile version