Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

পন্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট

হিরণ চন্দ্র নট্ট : অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার ঝালকাঠির (বর্তমানে জেলা) বাউকাঠি পাঁজিপুঁথিপাড়া গ্রামের এক সাংগীতিক পরিবারের ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত তবলাশিল্পী ও গুরু পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট। পিতা শশীভূষণ নট্ট ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত যাত্রাদল নট্ট কোম্পানির পরিচালক ও স্বত্বাধিকারী।

মা সারদা সুন্দরী নট্ট ছেলেবেলা থেকেই পুত্রের মধ্যে অসাধারণ প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখতে পান। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জীবনযাপনকারী পিতা শশীভূষণ তখনকার দিনে বেশ উঁচু মাপের তবলিয়া হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ফলে পিতার কাছেই তবলা শিক্ষার হাতেখড়ি হয় একেবারে শৈশবকালে। ছয় বছর বয়স থেকেই গুরু কালীপদ নট ও চাঁদপুরের তবলাগুরু চিন্তাহরণ নট্টবাবুর কাছে নিতে থাকেন তবলার তালিম। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তবলা বাদনে চমৎকার পারদর্শিতা অর্জন করেন তিনি।

গুণী পিতার যাত্রাদলের বিশেষ আকর্ষণ ছিল খুদে তবলাবাদক হিরণের বাজনা। মূল যাত্রাপালা শুরু হওয়ার আগে খুদে তবলাশিল্পীর অপূর্ব বাজনা উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার মনকে আন্দোলিত করে দিত। দিনে লেখাপড়া ও তবলা সাধনা এবং রাতে নিজেদের নট্ট কোম্পানির যাত্রাপালায় তবলা বাজানো – এভাবেই চলছিল তাঁর সাধকজীবন।

কিন্তু হৃদয়ে যার সুরের অবগাহন, নিজেকে সমৃদ্ধ করার অদম্য স্পৃহা, সুবিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের সান্নিধ্য লাভের হাতছানি মনকে করে তোলে উদাসীন সে কি আর নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে চায়? হঠাৎ একদিন মা-বাবা এবং যাত্রাদলের সদস্যদের মমতার বন্ধন ছিন্ন করে কাউকে কিছু না জানিয়ে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সুরের সন্ধানে পথে নামেন। ঘুরতে ঘুরতে হাজির হন তিনি সংগীতের সমৃদ্ধ নগরী বেনারস ও তীর্থস্থান কাশিতে।

এভাবে সফর করতে করতে ১৬ বছরের কিশোর হিরণ চন্দ্রের সুযোগ ঘটে তবলাগুরু পণ্ডিত আনখেলাল মিশ্র বাবুর সান্নিধ্য লাভের। একটানা পাঁচ বছর বেনারসে থেকে গুরুজির সেবা ও তবলা শিক্ষায় নিমগ্ন থাকেন তিনি।

এরপর বেনারস থেকে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে চলে আসেন বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চারণভূমি কলকাতায়। ধর্মতলা নিবাসী ভারতবিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আজিম খাঁ সাহেবের তখন অনেক নামডাক। ওস্তাদজির শরণাপন্ন হয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই তাঁর চরণে ঠাঁই মেলে হিরণ চন্দ্র নটের। সুন্দর ব্যবহার আর নম্র আচরণের গুণে সহজেই তিনি মন জয় করে নেন সকলের। ওস্তাদজির বাড়িতেই থাকার জায়গা মেলে এবং নিজ পুত্রের মতোই হিরণকে আপন করে নেন তিনি।

সেখানে প্রথমে তবলা শিক্ষা লাভের সুযোগ হয় ওস্তাদজির দাদিমার কাছে, যিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাময়ী গুণী একজন তবলাশিল্পী। প্রচলিত আছে ওস্তাদ আজিম খাঁ সাহেবের আঙুলের মিষ্টি ও সুগভীর টোকা দাদিমার কাছ থেকেই পাওয়া। পরে দাদিমার অনুমতিক্রমে ওস্তাদজি নাড়া বেঁধে হিরণ চন্দ্র নট্টকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।

সুদীর্ঘ ১০টি বছর পুত্রের মর্যাদায় ওস্তাদজির বাড়িতে থেকে তবলার নানা কৌশলের বাদনশৈলী তিনি রপ্ত করেন। সেখানে বড়মার (ওস্তাদজির দাদি) অপরিসীম আদরযত্ন ও দিকনির্দেশনা এবং ওস্তাদ আজিম খাঁ সাহেবের ভাণ্ডার উজাড় করা তালিম ক্রমান্বয়ে ঋদ্ধ করে তোলে হিরণ চন্দ্রকে। আন্তরিক প্রচেষ্টা, একনিষ্ঠ সাধনা, নিরলস পরিশ্রম আর অতুলনীয় গুরুভক্তির মধ্য দিয়েই কেটে যায় তাঁর সুদীর্ঘ ১০টি বছর।

এরই মধ্যে ওস্তাদজি সুযোগ্য শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে (১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) বিভিন্ন সংগীত আসর ও শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলনে যাতায়াত শুরু করেন। পরবর্তীকালে ওস্তাদজির অনুমতি লাভ করে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলনে যোগদান করে সংগতসহ একক তবলা পরিবেশন করতে থাকেন শিল্পী হিরণ চন্দ্র নট্ট।

একের পর এক বিভিন্ন সংগীত আসর ও সম্মেলনে যোগদান করে ভূয়সী প্রশংসার অধিকারী হন তিনি। সমসাময়িককালে কলকাতার তবলাশিল্পীদের মধ্যে পণ্ডিত হীরু গাঙ্গুলি, নাটু বাবু, পণ্ডিত বীরু মিশ্র, পণ্ডিত বিশ্বনাথ বোস, পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী এবং ওস্তাদ আজিম খা সাহেবের শিষ্য পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট হয়ে উঠেছিলেন বিশেষ খ্যাতিমান। সে সময় তিনি সংগীতজ্ঞ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ও পণ্ডিত কিষাণ মিশ্রের সঙ্গে নিয়মিত তবলা সংগত করতেন।

তখন পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তবলা বাজানো ছেড়ে দিয়ে কণ্ঠসংগীতে মনোনিবেশ করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেন এবং ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী ও পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট সে সময় আপন ভাইয়ের মতোই একত্রে চলাফেরা করতেন। ফলে অনেক সময় বিভিন্ন সংগীত আসরে এই দুই সংগীতগুণীজন একসঙ্গেই যোগ দিতেন। নিবিষ্ট সাধনা এবং কুশলী বাদনের গুণে তিনি মিনার্ভা থিয়েটার ও চলচ্চিত্রজগতে চাকরি করার সুযোগ লাভ করেন। কেমন জব্দ ছায়াছবিতে নৃত্যের সঙ্গে তাঁর তবলা বাদন অভাবনীয় প্রশংসা অর্জন করে।

তৎকালীন সময়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব বেশি থাকায় সংগীত আসরে কলাকারগণ নানান কলাকৌশলের অবতারণা করতেন। সেতারে ঝালা, বিভিন্ন কায়দা, পরন, তবলায় দম, বেদম, বেপরোয়া, তেহাই, আড়লয়, কু-আড়লয়, বাট-বাটরা ইত্যাদি মজাদার সংগীতযুদ্ধ মঞ্চে প্রদর্শিত হতো। পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট একজন সুদক্ষ ও কুশলী তবলাশিল্পী হিসেবে সব ধরনের সংগীত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রতিকূলতাকে জয় করে সকল দর্শক, আয়োজক, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও চমৎকৃত করে দিতেন।

শিক্ষাগুরুদের প্রতি অপরিসীম ভক্তি আর তবলা সাধনাকে তিনি উপাসনার মতো হৃদয়ে লালন করতেন। কলকাতায় থাকাকালীন কোনো সংগীত আসর বা সংগীত সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু ওস্তাদ আজিম খাঁ সাহেবের অনুমতি নিতে ভুলতেন না কখনো। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে পিতার মৃত্যু হলে পারিবারিক পেশা যাত্রাদল নট্ট কোম্পানির দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে।

পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার পাট চুকিয়ে শুরু হয় পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্ম ও জীবনযাত্রা। পারিবারিক প্রতিষ্ঠান যাত্রাদলের সংগীত, বাদ্য ও নাট্য পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পরও ডাক পেলেই ছুটে যেতেন সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে। সাত বছর পর ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মাতৃবিয়োগ হলে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির বাউকাঠি পাঁজিপুঁথিপাড়ায় ফিরে আসেন।

এ সময় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার ও সংগীতজ্ঞ বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে তাঁর দরবারে উপস্থিত হন পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট। জমিদার বাবু তাঁর সেতার বাদনের সঙ্গে তবলা সংগতের অনুরোধ জানালে শুরু হয় এক চমৎকার যুগলবন্দি। পণ্ডিতজির বাজনায় মুগ্ধ হয়ে সংগীতজ্ঞ বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তাঁকে থাকা-খাওয়াসহ আকর্ষণীয় বেতনে সভাবাদকের পদ অলংকৃত করতে অনুরোধ জানান।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আন্তরিক ইচ্ছা ও সম্মতি থাকা সত্ত্বেও মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সভাবাদক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হয় না তাঁর। কেননা সে সময়ের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ সাহেবের স্নেহাস্পদ শিষ্য ময়মনসিংহের গৌরীপুরের গুণী সেতারশিল্পী বিপিন দাস সংগীত আসরে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে ফেলেছেন। তাঁর বাজানো সেতার আর পণ্ডিতজির বাজানো তবলা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেন এক অভূতপূর্ব সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করত।

সেই সুর দর্শক শ্রোতার হৃদয়ে যে স্বর্গীয় অনুরণনের সৃষ্টি করত তা পৌঁছে দিত অমৃত সুরলোকে। সুরের জাদুতে মানবচিত্তকে মোহিত করে এই যুগলবন্দি তৎকালীন পূর্ব বাংলায় দারুণ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। নিবিষ্ট মনে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা, বিভিন্ন সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ আর শিক্ষার্থী তৈরিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন তিনি। সময়ের পরিক্রমায়

এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ কতগুলো বছর। দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে অস্থিরতা শুরু হলে এলোমেলো করে দিয়ে যায় অনেক কিছুই। সার্বিক পরিস্থিতির চরম বিস্ফোরণ ঘটলে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র আন্দোলন ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পণ্ডিতজির মুক্তিকামী মেজ পুত্র বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নরোত্তম চন্দ্র নট্টকে ধরে এনে ১৫ ডিসেম্বর সকালে ঝালকাঠি থানার ব্যারাকে গুলি করে হত্যা করে।

অকাল পুত্রবিয়োগের নিদারুণ শোকে নির্বাক হয়ে পড়েন পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হলেও পণ্ডিতজির হৃদয়ের সৃজনশীল উচ্ছ্বাস, তবলা বাদনে চমৎকার কারুকার্য, সুর নিয়ে আবেগঘন উচ্ছলতা সব যেন থমকে যায়। এক নিদারুণ গভীর বেদনায়।

নিত্য কর্মব্যস্ত জীবন থেকে তাঁর হারিয়ে যায় আনন্দ, স্পৃহা, উপলব্ধি, মননশীলতা এবং আগের মতো গতিশীল চমক। চার পুত্র পণ্ডিত পতিত পবন নট্ট, সমীর বরণ নট্ট, শংকর প্রসাদ নট্ট ও শেখর চন্দ্র নট্ট এবং একমাত্র কন্যা আরতি নট্টের মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজে ফিরতে থাকেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য বলিদান তরতাজা পুত্র নরোত্তমের মুখচ্ছবি।

বার্ধ্যকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ স্ত্রী পারুল রানী নট্ট (লক্ষ্মী), চার পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য শিষ্য ও গুণগ্রাহীকে রেখে সংগীতভুবনের উজ্জ্বল প্রতিভা তবলাগুরু পণ্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট নশ্বর পৃথিবী থেকে ব্যথাতুর অভিমানে চির বিদায় গ্রহণ করেন।

[ পন্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট ]

পন্ডিত হিরণ চন্দ্র নট্ট

আরও পড়ুন:

Exit mobile version