হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়একজন কিংবদন্তি বাঙালি কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক ছিলেন। তিনি হিন্দি সঙ্গীত জগতে হেমন্ত কুমার নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি বাংলা, হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। তিনি রবীন্দ্র সংগীতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন।

তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়ক বিভাগে দু-বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়াও ফিল্মফেয়ার সহ অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি উপমহাদেশের সবথেকে শ্রেষ্ঠ একজন শিল্পী ছিলেন, বিভিন্ন ঘরানার গানে তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। নানামুখী গানে আর কোন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সমকক্ষ হতে পারেনি।হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে বলা হয় সঙ্গীতের ঈশ্বর।

 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক

প্রারম্ভিক জীবন

শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২০ সালের  ১৬ জুন তার মাতামহের বাড়ি পবিত্র বারাণসী শহরে। তার মাতামহ ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক। তার পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। তার পরিবার কলকাতা শহরে আসে বিশ শতকের প্রথমার্ধে‌।

হেমন্ত সেখানে বড়ো হতে থকেন এবং প্রথমে নাসিরুদ্দিন স্কুল এবং পরবর্তীতে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, যিনি পরবর্তীকলে বাংলার স্বনামধন্য কবি হয়েছিলেন। ওই সময়কালে বিশিষ্ট লেখক সন্তোষকুমার ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওই সময়ে হেমন্ত ছোটো গল্প লিখতেন, সন্তোষ কুমার কবিতা লিখতেন এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় গান গাইতেন।

ইন্টারমিডিয়েট পাস করে হেমন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু তিনি সঙ্গীতের জন্য আপন শিক্ষা ত্যাগ করেন। তার সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন তিনি দেশ পত্রিকার জন্যে লেখেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন।

 

সংগীত কর্মজীবন

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে হেমন্ত তার বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাবে আকাশবাণীতে তার গান রেকর্ডিং করেন। গানের প্রথম লাইন ছিল ‘আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী’। হেমন্ত তার প্রারম্ভিক সঙ্গীত কর্মজীবনে পরামর্শদাতা হিসেবে পেয়েছিলেন বাংলা সঙ্গীতজ্ঞ শৈলেশ দত্তগুপ্তকে। প্রথম জীবনে হেমন্ত বাংলার প্রখ্যাত গায়ক পঙ্কজ মল্লিককে অনুসরণ করতেন। এজন্যে তার ডাকনাম ছিল ‘ছোটো পঙ্কজ’।

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে হেমন্ত উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি উস্তাদ ফৈয়াজ খানের শিষ্য ফণীভূষণ ব্যানার্জির কাছে ধ্রুপদী সঙ্গীতেরও তালিম নিয়েছিলেন, কিন্তু উস্তাদের অসময়ের মৃত্যুতে তার শিক্ষা অসমাপ্ত রয়ে যায়।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কলাম্বিয়ার লেবেলে হেমন্ত তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ করেন। চলচ্চিত্রের বাইরে রেকর্ডের ওই গানগুলো ছিল ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো বলো মোরে’, যেগুলোর কথা নরেশ ভট্টাচার্যের এবং সঙ্গীত শৈলেশ দত্তগুপ্তের। তার পর থেকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছর গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার (জিসিআই) জন্যে ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্রের বাইরে হেমন্তের রেকর্ড প্রকাশিত হোত।

তার প্রথম হিন্দি গানগুলো ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ এবং ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জিসিআইয়ের কলাম্বিয়া লেবেলেই প্রকাশিত হয়েছিল। ওই গানগুলোর সঙ্গীতকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত; কথা লিখেছিলেন ফৈয়াজ হাসমি।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র নিমাই সন্যাস চলচ্চিত্রে হেমন্ত প্রথম গান গেয়েছিলেন। সঙ্গীত দিয়েছিলেন হরিপ্রসন্ন দাস। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলা গানে হেমন্ত নিজে প্রথম সুর দিয়েছিলেন ‘কথা কোয়োনাকো শুধু শোনো’ এবং ‘আমার বিরহ আকাশে প্রিয়া’ এই দুটি গানে।

এগুলোর কথা লিখেছিলেন অমিয় বাগচি। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত অমরনাথের সঙ্গীত পরিচালনায় তিনি ইরাদা (১৯৪৪ চলচ্চিত্র) চলচ্চিত্রে প্রথম হিন্দি গানগুলো গেয়েছিলেন। হেমন্তকে শীর্ষস্থানীয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে ধরা হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় বান্ধবী বাংলা চলচ্চিত্রে তার প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করা হয়েছিল।গানটা ছিল ‘পথের শেষ কোথায়’।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দেই তিনি কলাম্বিয়া লেবেলের অধীনে চলচ্চিত্রের বাইরে প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করেন। গানগুলো ছিল ‘আমার আর হবে না দেরি’ এবং ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’। তার আগে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো/আকাশবাণীতে আমার মল্লিকাবনে রেকর্ড করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রেকর্ডটা বিস্মৃতিতে চলে গিয়েছে।[৪]

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সংগীত পরিচালক হিসেবে তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ছিল অভিযাত্রী। যদিও ওই সময় অনেক গান রেকর্ড করে হেমন্ত প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বড়ো বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিলেন। বাংলায় তার সমসাময়িক পুরুষ সঙ্গীত শিল্পীরা ছিলেন জগন্ময় মিত্র, রবীন মজুমদর, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত[৫] এবং তালাৎ মাহমুদ।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলার দুজন প্রধান সংগীতকার নচিকেতা ঘোষ এবং রবিন চট্টোপাধ্যায়, যাঁরা ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দশকের প্রথমদিক থেকে হেমন্তের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতেন।

 

পরিবার

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা তিন ভাই এবং এক বোন, নীলিমা। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে হেমন্ত বাংলা সঙ্গীত শিল্পী বেলা মুখোপাধ্যায়ের (মৃত্যু ২৫ জুন ২০০৯),[৭] সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন কিন্তু বিবাহের পর বেলা আর সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেননি। তাঁদের দুই সন্তান — পুত্র জয়ন্ত এবং কন্যা রাণু।

 

 

YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

উত্তরাধিকার

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রায় দেড়শোটি বাংলা ছবিতে সুর দিয়েছেন, গান গেয়েছেন। তার প্রয়াণের প্রায় দুই দশক পরেও গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া প্রত্যেক বছর অন্তত একটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অ্যালবাম প্রকাশ করে থাকে, বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা থাকায় তার পুরোনো গানের পুনর্প্রস্তুতকরণ করে। যে গান তিনি রেকর্ড করেছেন, যে সুর তিনি সৃষ্টি করেছেন, এবং অসংখ্য গায়ক বাংলা এবং ভারতে তার গায়কী ধরন অবিরত নকল/অনুকরণ করার ফলে তার উত্তরাধিকার এখনো জীবন্ত।

মৃত্যু

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার গ্রহণের জন্যে তথা একটা কনসার্টে সংগীত পরিবেশনের তাগিদে হেমন্ত বাংলাদেশের ঢাকা শহরে ভ্রমণ করেছিলেন। ওই সফরের অব্যবহিত পর ফিরেই ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি আর একটা হৃদাঘাত পেয়েছিলেন এবং দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিং হোমে রাত ১১:১৫টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

পুরস্কার

  • পদ্মশ্রী(অস্বীকৃতি)
  • পদ্মভূষণ(অস্বীকৃতি)
  •  ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড: নাগিন
  • ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার
  • বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড
  • বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড
  • বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডি.লিট
  • সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার
  • মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
  • প্রথম ভারতীয় গায়ক হিসেবে হলিউডের সিনেমায় নেপথ্য কন্ঠ দান ও আমেরিকা সরকার কর্তৃক বাল্টিমোর এর
  • নাগরিকত্ব লাভ
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৈত্রী পুরস্কার (মরণোত্তর)

Leave a Comment