হেমেন্দ্রকুমার রায় । বাঙালি সাহিত্যিক এবং গীতিকার

হেমেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক, গীতিকার শিল্প সমালোচক, যিনি বিশেষ করে শিশু সাহিত্য, রহস্যরোমাঞ্চ গোয়েন্দা গল্পের জন্য সুপরিচিত। তার অনেক লেখা গল্প উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে এবং বাংলা কিশোর সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।

 

হেমেন্দ্রকুমার রায় । বাঙালি সাহিত্যিক এবং গীতিকার

 

প্রাথমিক জীবন

হেমেন্দ্রকুমার রায় ১৮৮৮ সালের সেপ্টেম্বর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল প্রসাদদাস রায়, পিতার নাম রাধিকাপ্রসাদ রায়। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য চর্চায় তিনি আগ্রহী ছিলেন এবং মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েসে সাহিত্য লিখা শুরু করেন।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে আমার কাহিনী’ শিরোনামের তার প্রথম গল্প বসুধা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে তিনি ১৩২২ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকায় লিখা শুরু করেন, যা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদিত। এছাড়া তিনি সাপ্তাহিক ‘নাচঘর’ (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) সম্পাদনা করেন। মাসিক পত্রিকা রংমশাল’ প্রভৃতিতেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

 

সাহিত্যিক ও লেখক জীবন

হেমেন্দ্রকুমার রায় শিশুদের জন্য ৮০টিরও বেশি বই লিখেছেন। এই বইগুলোতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • কবিতা নাটক
  • হাস্য ভূতের গল্প
  • অ্যাডভেঞ্চার গোয়েন্দা কাহিনি
  • ঐতিহাসিক উপন্যাস

তার সৃষ্টি করা বিমল-কুমার জুটি, জয়ন্ত সহকারী মানিক, পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু, এবং ডিটেকটিভ হেমন্ত বাংলা কিশোর সাহিত্যে আজও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বড়দের সাহিত্য

হেমেন্দ্রকুমার রায় বড়দের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • জলের আলপনা
  • বেনোজল
  • পদ্মকাঁটা
  • ঝড়ের যাত্রী
  • যাঁদের দেখেছি
  • বাংলা রঙ্গালয়
  • শিশিরকুমার
  • ওমর খৈয়ামের রুবায়াত

তার গল্প সিঁদুর চুপড়ি’ জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে একটি সংকলনে স্থান পেয়েছিল। এছাড়া বিমল কুমারের অভিযান অবলম্বনে লেখা যকের ধন’ দুইবার চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।

 

গীতিকর ও থিয়েটার কার্যক্রম

হেমেন্দ্রকুমার রায় সফল গীতিকার ছিলেন। তিনি বাংলা থিয়েটার ও গ্রামাফোনের গানকে নতুন রূপ দেন। তার রচিত অন্ধকারের অন্তরেতে’ গানটি সেই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।

তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ীর ‘সীতা’ নাটকের নৃত্য পরিচালক ছিলেন। এছাড়া হেমেন্দ্রকুমার চমৎকার ছবি আঁকতেও পারতেন এবং বাংলায় শিল্প সমালোচনার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন।

 

চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সাহিত্য চলচ্চিত্রে বহুবার চিত্রায়িত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য:

  • দেড়শো খোকার কাণ্ড – ১৯৫৯ সালে চলচ্চিত্রায়িত
  • নিশীথিনী বিভীষিকা – ১৯৫১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র জিঘাংসা’ হিসেবে এবং ১৯৬২ সালে হিন্দিতে বিশ সাল বাদ’
  • রাত্রির যাত্রী – টেলিসিরিয়াল আকারে প্রচারিত
  • যকের ধন – ১৯৩৯ সালে হরিচরন ভঞ্জ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র, যেখানে অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী, অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলি
  • ২০১৭ সালে পুনঃনির্মিত যকের ধন’ – অভিনয় করেছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী প্রমুখ।

 

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

হেমেন্দ্রকুমার রায় বাংলা শিশু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং রহস্য-রোমাঞ্চ গোয়েন্দা গল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তার গল্পগুলোতে কিশোরদের বুদ্ধি, সাহস নৈতিকতা বিকশিত হয়।

শিশু সাহিত্য ও বাংলা গীতিকলা ছাড়াও তিনি নাটক, চিত্রকলা শিল্প সমালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

 

হেমেন্দ্রকুমার রায় । বাঙালি সাহিত্যিক এবং গীতিকার

 

হেমেন্দ্রকুমার রায় শুধুমাত্র একজন শিশু সাহিত্যিক নন, তিনি গীতিকার, চিত্রশিল্পী সংস্কৃতিক চিন্তাবিদ হিসাবেও পরিচিত। তার সৃষ্ট বিমল-কুমার অন্যান্য চরিত্র বাংলা সাহিত্যকে চিরস্মরণীয় করেছে। চলচ্চিত্রায়িত গল্পগুলো ও জনপ্রিয় গানগুলি তাকে বাংলা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

Leave a Comment