Site icon সঙ্গীত গুরুকুল, GOLN

হ্যাপী আখন্দ । বাংলাদেশী গায়ক এবং সংগীত আয়োজক

হ্যাপী আখন্দ ছিলেন একজন বাংলাদেশী গায়ক এবং সংগীত আয়োজক, যাকে সঙ্গীতের জগতে বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র হিসেবে সমাদৃত করা হত। তিনি শুধুমাত্র কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নয়, বরং একজন প্রতিভাবান সংগীত আয়োজক হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি অমর সংগীতজ্ঞ আর ডি বর্মণ, আব্বাসউদ্দীন, মান্না দে, সমর দাশের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের কাছ থেকে প্রশংসা এবং স্নেহ অর্জন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে হঠাৎ করেই তিনি আমাদের মাঝে ছেড়ে চলে যান।

 

হ্যাপী আখন্দ । বাংলাদেশী গায়ক এবং সংগীত আয়োজক

 

 

প্রাথমিক জীবন

হ্যাপী আখন্দ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৩ সালের ১২ই অক্টোবর ঢাকার পাতলা খান লেনে। জন্মের সময় তাঁর ছোট ভাই লাকী আখন্দ তার হাতে একটি পয়সা গুজে দিয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে, প্রায় ৪–৫ দিন পরও, হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরেও সেই পয়সাটা তার হাতে অক্ষত রয়ে যায়।

ছোটবেলায় হ্যাপী আখন্দ কাককে ডেকে ভাত খাওয়াতেন, যা তার সহমর্মিতা ও উদার মনোভাবের প্রমাণ। তিনি কোন বিষয় একবার শুনলেই তা মুখস্থ করতে পারতেন, যা পরবর্তীতে তার সংগীত দক্ষতায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি গিটারের তাল ধরতে সক্ষম হন। শুরুর দিকে হ্যাপী আখন্দ তার ভাই লাকী আখন্দের সঙ্গে বিভিন্ন কনসার্টে অংশ নিতেন, প্রাথমিকভাবে তবলা বাজানোর জন্য

 

ব্যান্ড গঠন

হ্যাপী আখন্দ গঠন করেছিলেন উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’, যা ছিল একটি পাকিস্তানি ব্যান্ড। এই ব্যান্ডে তিনি দক্ষভাবে গিটার বাজাতেন এবং গান গাইতেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতার মধু মুখার্জিকে শিক্ষা দিয়েছেন।

১৯৭৫ সালে এসএম হেদায়েত লিখিত এবং লাকী আখন্দ সুরিত গান আবার এলো যে সন্ধ্যা’-র সংগীত আয়োজন করে হ্যাপী আখন্দ বাংলাদেশ টেলিভিশনে পরিবেশন করেছিলেন। যদিও হ্যাপী এবং লাকীর বয়সের ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর, তবুও তারা একে অপরকে বন্ধুর মতো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতেন

জাতীয় উৎসবের সঙ্গে সম্পর্ক: ১৯৭২ সালের পর থেকে হ্যাপী আখন্দ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করতেন, যা তাকে দেশের সাংস্কৃতিক জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জাতীয় চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিল।

 

জনপ্রিয় গান

হ্যাপী আখন্দের গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

তাঁর সংগীত আয়োজনে ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া এমন একটা মা দে না’ এবং প্রয়াত ফিরোজ সাঁইয়ের গাওয়া ইশকুলখুইলাছে রে মাওলা’ গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

হ্যাপী আখন্দের পরিবার সংগীত পরিবার হওয়ায় তিনি তার বাবা এবং বড় ভাই লাকী আখন্দ থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর আবেশী কণ্ঠস্বর, গিটার, পিয়ানো, তবলা সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সহজাত্ম দক্ষতা সেই সময়ের শ্রোতা ও শিল্পীদেরকে মুগ্ধ করত।

 

সংগীত প্রতিভা ও অবদান

লাকী আখন্দ বলেন,

“হ্যাপির সংগীত-প্রতিভা ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিস্ময়কর। সংগীতের প্রতি তাঁর একাগ্র নিষ্ঠা ও ভালোবাসা, সঙ্গে স্রষ্টা প্রদত্ত কিছু সহজাত গুণাবলি ও দক্ষতার কারণে তিনি আমাদের সময়ের সকল শিল্পীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ছিলেন। নিজের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে হ্যাপি শ্রোতাদের হৃদয়ের সব বন্ধ জানালা খুলে দিতে পারতেন।”

হ্যাপী আখন্দ গিটার, পিয়ানো, তবলা—যা-ই বাজাতেন, তা শ্রোতাদের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালোলাগা সৃষ্টি করত। তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে সংগীতের জ্ঞান ও দর্শন অর্জন করতেন এবং তা অকাতরে ভাগাভাগি করতেন বন্ধুপ্রতিম সহশিল্পী এবং ছাত্রদের মধ্যে।

একবার কলকাতার এইচএমভি সংগীত প্রযোজনা সংস্থার রেকর্ডিংয়ে হ্যাপী এবং আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে কাজ করার সময়, হ্যাপী তবলা বাজানোর সময় “বায়া” দিয়ে এমন সুন্দর তাল তৈরি করেছিলেন যে রেকর্ডিং সংস্থার পরিচালক কলিম শরাফী অবাক হয়ে রেকর্ডিং রুমে ঢুকে দেখেছিলেন।

হ্যাপী আখন্দের জীবন ছিল সংগীতের প্রতি অদম্য নিষ্ঠা, উদ্ভাবনী শক্তি সৃজনশীলতার প্রতীক, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কেটেছে অনেক অভিমান এবং কষ্টের মধ্যে

 

 

হ্যাপী আখন্দ ছিলেন বাংলাদেশের সংগীত জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যার সঙ্গীত প্রতিভা, সংগীত আয়োজন দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার কারণে তিনি আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে অম্লান স্থান অধিকার করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সমন্বয়ে তার কণ্ঠ, বাদ্যযন্ত্রে দক্ষতা এবং নবীনদের প্রতি উদারতা তাকে এক অনন্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

Exit mobile version