হোরি: ব্রজভূমির রঙিন লোকসঙ্গীত

হোরি হলো ব্রজ ভাষায় গাওয়া এক ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীতের ধারা, যা মূলত ভারতের উত্তরপ্রদেশের ব্রজ অঞ্চলে প্রচলিত। এই সঙ্গীত ধারাটি হোলি উৎসবের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এবং উৎসবের আনন্দঘন পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। হোরি গান শুধু সঙ্গীত নয়, বরং এটি সংস্কৃতি, আচারঅনুষ্ঠান, প্রেম রসের আখ্যানের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

 

সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক উৎস

 

সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক উৎস

ব্রজভূমি, অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের পবিত্র ভূমি, তার সমৃদ্ধ সঙ্গীত ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। ব্রজভূমির এই সংগীত ঐতিহ্যে হোরি গান একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। গানগুলোতে দেখা যায় কৃষ্ণরাধার রঙের খেলা, দুষ্টুমি, প্রেম এবং লীলাভঙ্গিমার বর্ণনা, যা স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক।

হিন্দু পঞ্জিকার ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায়, অর্থাৎ মার্চ মাসে, যখন হোলি উদ্‌যাপন করা হয়, তখনই এই গানগুলো পরিবেশিত হয়। সাধারণত মন্দির প্রাঙ্গণ, গ্রামের আঙিনা বা সামাজিক উৎসবস্থলে হোরি গান পরিবেশিত হয়। এই গান বসন্তের বার্তা, মিলনের আনন্দ এবং সামাজিক সংযোগ বহন করে।

 

সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য

হোরি গান মূলত লোকসঙ্গীত, তবে এটি কখনো কখনো হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রূপেও পরিবেশিত হয়। গানগুলো সাধারণত হালকা রাগে রচিত এবং কেহরবা বা দাদরা তালে পরিবেশিত হয়।

গানের বিষয়বস্তু সাধারণত প্রেম, বিচ্ছেদ, পুনর্মিলন লীলাভঙ্গিমা-এর উপর ভিত্তি করে লেখা হয়। হোরি গানের দুইটি প্রধান ধারা রয়েছে:

  1. ধ্রুপদ হোরি – ধীর লয়ে, ভক্তিমূলক আবহে পরিবেশিত হয়।
  2. ঠুমরী হোরি – তুলনামূলকভাবে হালকা, রসিক এবং প্রেম ও খেলার মেজাজ প্রবল।

এই ধারা দুটোই হোলি উৎসবের আনন্দময় পরিবেশকে বৃদ্ধি করে এবং শ্রোতাদের মধ্যে ভক্তি আনন্দের মিলন ঘটায়

 

হোলি উৎসবে হোরির গুরুত্ব

ব্রজ অঞ্চলে হোলি উৎসব হোরি গান ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। এই গানগুলো শুধুমাত্র বিনোদনের উপকরণ নয়; বরং এটি মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক সামাজিক সংযোগ সৃষ্টি করে।

  • পেশাদার শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই মিলে হোরি গান পরিবেশন করেন।
  • উৎসবের আনন্দ বহুগুণ বাড়ানোর জন্য অনেক স্থানে হোরি দঙ্গল অনুষ্ঠিত হয়—একধরনের গানের প্রতিযোগিতা যেখানে বিভিন্ন দল পালা করে গান গেয়ে নিজেদের রস, ছন্দ কবিত্ব প্রকাশ করে।
  • মন্দির প্রাঙ্গণ, বৃন্দাবনের অলিতে-গলিতে এবং গ্রামের আঙিনায় হোরি গান পরিবেশিত হয়, যা উৎসবকে প্রাণবন্ত আনন্দময় করে তোলে।

 

আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

আজও হোরি গান গ্রামবাংলার মঞ্চ, মন্দিরের আঙিনা এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে গুরুত্ব সহকারে পরিবেশিত হয়। অনেক বিশিষ্ট শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হোরির ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কাজ করছেন।

  • উদাহরণস্বরূপ, সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হোলি উপলক্ষে হোরি পরিবেশনার আয়োজন করে থাকে।
  • হোরি গান শুধুমাত্র উৎসবের গান নয়, বরং এটি এক জীবন্ত লোকজ ঐতিহ্য, যা ব্রজের সাংস্কৃতিক রস, হোলির প্রাণময়তা এবং ব্রজ ভাষার কাব্যিক সৌন্দর্যকে একত্রে উপস্থাপন করে।

শাস্ত্রীয় গানের আসরে হোক বা বৃন্দাবনের অলিতে-গলিতে, হোরি আজও সঙ্গীত, ভক্তি এবং আনন্দের এক মহামিলন হিসেবে রয়ে গেছে।

 

হোরি: ব্রজভূমির রঙিন লোকসঙ্গীত

 

হোরি গান ব্রজভূমির লোকসংগীতের একটি প্রাণবন্ত, রঙিন এবং ঐতিহ্যবাহী ধারা, যা শুধু হোলি উৎসবের আনন্দ বৃদ্ধি করে না, বরং মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক সংযোগও জাগিয়ে তোলে। এই গানগুলো বর্তমানেও লোকসংগীত এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধন হিসেবে জীবন্ত রয়েছে এবং ভক্তি ও আনন্দের উৎস হিসাবে সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।