ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন (১৯০৭-১৯৭৬) রাজশাহী, বাংলাদেশ [ Ustad Mozammel Hossain (1907-1976), Rajshahi, Bangladesh ] : রের সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ এক সাধক সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত নদীয়া জেলার ঐতিহাসিক শহর নবদ্বীপে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ৯ ফেব্রুয়ারি) এই সাধক শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হারানউদ্দিন ঝকু ছিলেন একজন শৌখিন সেতারশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী। সংগীতানুরাগী পিতার কাছেই সংগীতের হাতেখড়িসহ প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মোজাম্মেল।
শিশুমনের আগ্রহ আর একাগ্রতায় মুগ্ধ হয়ে পিতা তার জানা সবটুকু সংগীতবিদ্যাতেই পারদর্শী করে তোলেন আদরের পুত্র মোজাম্মেলকে। পুত্রের বয়স বিশ বছর পূর্ণ হলে তিনি সেনি ঘরানার অনুসারী ভারতের অন্যতম গুণী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ বাদল খাঁর শিষ্য প্রফেসর নগেন্দ্রনাথ দত্তের হাতে তুলে দেন তাকে। সেই থেকে শুরু হয়। সুরপাগল মোজাম্মেলের বিধিবদ্ধ নিবিষ্ট সংগীতসাধনা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একাগ্রচিত্তে সুরের নিবিড় বন্ধনে চলতে থাকে তাঁর কঠোর অনুশীলন।
কলকাতার বলরাম স্ট্রিট থেকে কখনো ট্রামে চড়ে, আবার কখনো হেঁটে প্রতি সন্ধ্যায় যেতেন ওস্তাদের বাড়িতে তালিম গ্রহণ ও অনুশীলনের জন্য। নিয়মিত প্রায় আট ঘণ্টা চলত তাঁর সংগীত সাধনা। প্রচণ্ড গুরুভক্তি, সহজ-সরল স্বভাব, বিনয়ী মনোভাব এবং আন্তরিক সেবা প্রদানের জন্য অল্প দিনের মধ্যেই প্রফেসর দত্তের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন মোজাম্মেল হোসেন। এমনকি ৭০ বছর বয়সী দাদা ওস্তাদ বাদল খাঁর নেক নজরে পড়তেও সময় নেননি তিনি।
ফলশ্রুতিতে ওস্তাদ বাদল খাঁ সাহেবের একান্ত সাহচর্যসহ দীর্ঘ চার বছর সময় অমূল্য তালিম লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ লাভ হয় তাঁর। শুধু তা-ই নয়, সমসাময়িক গুরুভাইদের বন্ধুত্বকে রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করার সুযোগও সে সময় হয়েছিল এই গুনীজনের।
ওস্তাদের কাছ থেকে নিয়মিত তালিম গ্রহণ করে শুরু হয় তাঁর কঠোর সাধনা। একজন বড় কণ্ঠশিল্পী হবেন সেই বাসনা হৃদয়ে লালন করে দিনের অধিকাংশ সময় কাটত সংগীতসাধনায়। তাই পৈতৃক বাদ্যযন্ত্রের দোকানে ঠিকমতো মনোনিবেশ করা হয়ে উঠত না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। তবু সংগীতের মোহনীয় আকর্ষণ সাধনা থেকে তাঁকে এক মুহূর্ত বিরত থাকতে দেয়নি।
এ সময়ে তিনি বিভিন্ন সংগীতসাধকের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান-বাজনা শুনতেন মোজাম্মেল হোসেন। সংগীত পরিবেশনের সময় বড় বড় ওস্তাদদের নানা জাদুকরী সুরের ছন্দবিন্যাস তাঁকে মুগ্ধ করে দিত। এসব দেখে একজন বড় শিল্পী হওয়ার বাসনা তাঁর মনে আরো তীব্র হয়ে ওঠে এবং রেওয়াজের মাত্রা তিনি আরো বাড়িয়ে দেন। এরই মধ্যে রাবেয়া খাতুনকে বিয়ে করে সংসারধর্মও শুরু করেন তিনি।
একদিকে জীবনসংসার অপরদিকে সুরের সাধনা চলতে থাকে সমান গতিতে। কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে যখন তিনি অনেকদূর এগিয়ে যান সে সময় একমাত্র কন্যার অকালমৃত্যু হঠাৎ করেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে জর্জরিত করে দেয় তাঁকে। এই দুর্ঘটনাটি তাঁর জীবনের ছন্দের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে সূচনা করে বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। নিদারুণ শোক বুকে নিয়ে চালিয়ে যেতে থাকেন অক্লান্ত সংগীতসাধনা।
মানসিক যাতনা, অর্ধাহার, অনাহার, মাঝে মাঝে অনিদ্রা এসব অনিয়মের ফলে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি শিকার হন হাঁপানি ও ব্রংকাইটিস রোগে। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর কণ্ঠ রোগাক্রান্ত হয়ে হারিয়ে ফেলে সাধনালব্ধ সুর। অনেক চিকিৎসার পরও কণ্ঠের সুস্থতা এবং স্বাভাবিকতা ফিরে পাননি তিনি। সেই বিপর্যয়ের সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় গুরু সংগীতজ্ঞ অধ্যাপক নগেন দত্ত আশার আলো জ্বেলে সামনে এসে দাঁড়ান। তিনি বলেন,
মোজাম্মেল তোর কণ্ঠ থেকে সুর মুছে যাচ্ছে, তোর সেই সুরেলা কণ্ঠ হয়তো
তুই আর ফিরে পাবিনে। কিন্তু তোর হৃদয়ে দীর্ঘদিনের যে শিক্ষা আর
অভিজ্ঞতার ফসল গাঁথা আছে, তা নিয়ে তুই সামনে এগিয়ে যা।
নিরুপায় মোজাম্মেল হোসেন গুরুজির পরামর্শে তাঁরই বন্ধু গাওহার আলী খাঁর কাছে কিছুদিন এবং পরে গোপাল প্রামাণিকের কাছে তবলা শিক্ষা শুরু করেন। দিন গড়িয়ে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে মোজাম্মেল-রাবেয়া দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেয় পুত্র রবিউল হোসেন। পিতার পথ অনুসরণ করে পরবর্তীকালে যিনি হয়েছিলেন বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত ভুবনের একজন ঋদ্ধ সাধক ও শিল্পী গড়ার মহান কারিগর।
স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসারধর্ম ভালোমতোই চলছিল সুরসাধক মোজাম্মেল হোসেনের। কিন্তু বুকের ভেতর তাঁর বাসা বেঁধেছিল নিদারুণ এক হাহাকার আর দুঃসহ অতৃপ্তি। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি কখনো, বরং কণ্ঠসংগীতের অভিজ্ঞতা, লয়, আড়ি, কুআড়িসহ সকল নান্দনিকতাকে তবলা বাদনে কাজে লাগাতে থাকেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে ‘সুর সংঘ অর্কেস্ট্রা ক্লাব’ নামে গড়ে তোলেন শুদ্ধ সংগীত শিক্ষা প্রদানের এক অসাধারণ প্রতিষ্ঠান।
জীবনের বড় সাধ যখন পূরণ হলো না তখন দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সংগীতভাণ্ডারকে শিষ্যবৃন্দের মাঝে উজাড় করে দেওয়া শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেশ কজন নিবেদিতপ্রাণ শিষ্যও পেয়ে যান। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ইব্রাহিম হোসেন, রাধেন গোসাই, আসগর আলী, গৌরে মালি, ইয়াসীন আলী প্রমুখ ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন রাজশাহী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী বজলার রহমান। বাদল। তার এবং রঘুনাথ দাসের সঙ্গে গ্রাম, গঞ্জ, নগর, বন্দরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তবলা বাজিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন মোজাম্মেল হোসেন।
ধীরে ধীরে তাঁর নাম এবং বাদনখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে সাংস্কৃতিক মহলে। সে সময়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন, সালাম খান চৌধুরী, সারদা কিংকর মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। সত্য ও সুন্দরের পূজারি এই মহান সাধকের গুণের কদর করতে বিলম্ব করেননি তৎকালীন লক্ষ্মীপুর শিল্পী পরিষদের সদস্যবৃন্দ।
ধীরে ধীরে সংগীতশিক্ষক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন। সরলতা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও বন্ধুবাৎসল্যের গুণে রাজশাহীর সুধীসমাজ এবং আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নেন অচিরেই। রাজশাহীর আলো-বাতাসে যখন তিনি আপন হয়ে ওঠেন ঠিক সেই মুহূর্তে সুখ-দুঃখের ঝড় একসঙ্গেই নাড়া দিয়ে যায় তাঁর কোমল হৃদয়কে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার বছর (১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ) কন্যাসন্তান মনোয়ারা জন্মের পর স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের অকাল বিয়োগ ঘটে। পরবর্তী সময়ে তিনি কুলসুম বেগমকে বিয়ে করে সংসারে নিয়ে আসেন।
শাস্ত্রীয় সংগীতের একনিষ্ঠ সাধক ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের অসংখ্য শিষ্য রেখে গেছেন। যাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাদের একটি তালিকা দেয়া হলো।
ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের শিষ্যবৃন্দ:
- শিষ্যবৃন্দের মধ্যে আখতার জাহান (কণ্ঠসংগীত শিল্পী)
- অধ্যাপক আফরোজা আহমেদ (রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী)
- ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু (উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী)
- আব্দুল মালেক খান গজনবী (উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী)
- ইব্রাহিম হোসেন (কণ্ঠসংগীত শিল্পী)
- ইয়াসীন আলী (তবলাশিল্পী)
- খন্দকার মনসুরুল হুদা (রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী)
- গোলাম মোস্তফা (লোকসংগীত শিল্পী),
- অধ্যাপক জাহানারা বেগম বেগু (কণ্ঠসংগীত শিল্পী)
- দীল রওশন (জলতরঙ্গ ও কণ্ঠসংগীত শিল্পী)
- নাসির উদ্দিন আহমেদ তারা (কণ্ঠসংগীত শিল্পী)
- বজলার রহমান বাদল (উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী)
- ওস্তাদ রবিউল হোসেন (উচ্চাঙ্গসংগীত ও তবলাশিল্পী)
- শামসুজ্জামান (রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী)
- শেখ আব্দুল আলীম (উচ্চাঙ্গসংগীত ও নজরুলগীতি শিল্পী)
- সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর হারুন অর রশীদ কলিন (উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী)
ওস্তাদজিকে কেন্দ্র করেই ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে গুণমুগ্ধ শিষ্য আবদুল আজিজ বাচ্চু, মুস্তাফিজুর রহমান, আব্দুল মালেক খান গজনবী, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের সক্রিয় প্রচেষ্টায় ‘সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সময় রাজশাহীর অনেক সংগীত শিক্ষার্থী ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের কাছে তালিম গ্রহণের সুযোগ পায়।
তাদের মধ্যে শেখ আব্দুল আলীম, ইরা ইসলাম, মহসিন প্রামাণিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে-সময় রাজশাহীর স্বনামধন্য অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমেদ নিজ পুত্র-কন্যাদের সংগীতশিক্ষা প্রদানে আগ্রহী হন। ওস্তাদজির ওপর সেই দায়িত্ব অপর্ণসহ এই গুণীজনকে আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা প্রদান করে সম্মানিত করেন। সংগীতগুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যাপক মফিজউদ্দিনের মতো নলিনী মোহন মজুমদারও ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের শেষ জীবন পর্যন্ত তাঁর পাশে ছিলেন।
![ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন [ Ustad Mozammel Hossain ] 6 YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন [ Ustad Mozammel Hossain ]](https://sp-ao.shortpixel.ai/client/to_auto,q_glossy,ret_img,w_160,h_120/https://bn.musicgoln.com/wp-content/uploads/1965/12/YaifwwriN4BzRFCyqbslL4-300x225.png)
গুণমুগ্ধ ছাত্র শেখ আব্দুল আলীম ও আজিজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও লেখিকা বেগম সুফিয়া কামালের একান্ত অনুরোধে তিনি বিখ্যাত ‘কাকলী ললিতকলা একাডেমি‘র প্রধান সংগীতশিক্ষক পদে যোগদান করেন। ওস্তাদজি ছিলেন একাধারে সুরসাধক, তবলাবাদক, চিত্রকর ও মৃৎশিল্পী। তাঁর শিল্পীসুলভ সহজ-সরল আন্তরিকতা ও বিনয়ী আচরণের জন্য সবার কাছে ছিলেন বিশেষ সম্মানের পাত্র।
জুলাই মাস ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় দিনটি ছিল শুক্রবার। ঘড়িতে তখন ঠিক বিকেল ৪টা ১৩ মিনিট। মেঘের ফাঁকে বিকেলের সূর্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে ছড়িয়ে দিয়েছে রক্তিম-সোনালি আভা। সাধক শিল্পী ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন ঠিক সেই মুহূর্তে অসংখ্য গুণগ্রাহীকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ঢলে পড়েন চিরনিদ্রার কোলে।
[ ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন (১৯০৭-১৯৭৬) রাজশাহী, বাংলাদেশ ]
আরও দেখুন: