রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো

রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো ভারতীয় রাগশাস্ত্রে বর্ণিত একটি প্রাচীন রাগ। একে বলা হয় আদি রাগ। দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে এই রাগের নাম মায়ামালবগৌড়।

cropped Music Gurukul Logo রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো

রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো

ব্রহ্মা, কল্পিনাথ, হনুমন্ত, ভরত- রাগ শ্রেণিকরণে দেখা যায় আদিতে এই রাগ আরো কিছু রাগের অধিকর্তা ছিল। অধীনস্থ এই রাগগুলো ছিল ভৈরব রাগের স্ত্রী। তাই এই রাগগুলোকে তখন বলা হতো- রাগিণী। এর অধীনস্ত যে রাগিণীগুলোর নাম পাওয়া যায়, তা হলো-

ব্রহ্মামত

রাগ: ভৈরব
রাগিণী : ভৈরবী, গুর্জ্জরী, রামকলী, গুণকলি, সৈন্ধবী, বাঙ্গালী

কল্পিনাথ মত:

রাগ: ভৈরব
রাগিণী: ভৈরবী, গুর্জ্জরী, বেলাবেলী, বিহাগ বা বাদহংসী, কর্ণাট, কানাড়া বা ভাষা

হনুমন্ত মত:

রাগ: ভৈরব
রাগিণী: মধুমাধবী, ভৈরবী, বঙ্গালী, বরাড়ী, সিন্ধু (সৈন্ধবী)

ভরত মত:

রাগ: ভৈরব
রাগিণী: মধুমাধবী, ভৈরবী, বাঙ্গালী, বরারী, সৈন্ধবী
পুত্র: বিলাবল, পঞ্চম, দেসাখ্য, দেবগান্ধার, বিভাষ
পুত্রবধূ: রামকলী, সুহাই, সুঘরাই, পটমঞ্জরী, তোড়ি

প্রাচীন ভৈরব ঋষভ ও পঞ্চম ছিল না। ফলে রাগটি ছিল ঔড়ব-ঔড়ব। রেখাব ও পঞ্চমবিহীন ঔড়ব জাতীয় ভৈরবকে অনেকে সরস্বতী ভৈরব বা আদি ভৈরব বলে থাকেন।

রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো

 

ভৈরবাঙ্গ:

ভৈরবের আরোহণ ও অবরোহণের বিন্যাসকে দুটি অঙ্গে বিভাজিত করে বিবেচনা করা হয়। এর একটি হলো- পূর্বাঙ্গ অপরটি উত্তরাঙ্গ। এর পূর্বাঙ্গে রয়েছে গ ম প গ ম গঋ, স। এই স্বরবিন্যাসে শুরু হয় শুদ্ধ গান্ধার থেকে এবং ম প গ ম ঘুরে ঋ-তে আসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ন্যাস স্বর মধ্যম। তারপর ঋ স। মধ্যমে ক্ষণিক বিরাম, এই জন্য ভৈরবে মধ্যম ন্যাস স্বর। এর মধ্য দিয়ে একটি সুরাঙ্গের তৈরি হয়। এর সাথে বিশেষ শর্ত থাকে গান্ধার ছুঁয়ে ঋষভে পৌঁছানো এবং ঋষভে আন্দোলন। কিম্বা মা থেকে ঋষভে পৌঁছাতে হয় একটি বিলম্বে মীড় যুক্ত হয়ে। এর ভিতরে গান্ধার না থাকলেও ক্ষতি নেই।

ভৈরবের উত্তরাঙ্গে রয়েছে দ ন র্স। এই উত্তরাঙ্গে পৌঁছানোর শুরুতে কোমল নিষাদ ছুঁয়ে ধৈবতে বিরাম। অর্থাৎ গ ম ণদ। তারপর পঞ্চমে সামান্য একটি স্থিতি তারপর পূর্বাঙ্গের স্বরবিন্যাসে ফিরে আসা। সব মিলিয়ে দাঁড়ায়- গ ম ণদ, প, প গ ম গঋ, স। এখানে বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- ণদ। কিন্তু যখন শুদ্ধ নিষাদ থেকে কোমল ধৈবতে নামার প্রয়োজন হয়, তখন বিলম্বে ও মীড়যুক্ত হয়ে উপস্থাপন করা হয়। একইভাবে স থেকে দ-তে পৌঁছানোর সময় মীড়ের প্রয়োগ করা হয়। এ সকল বৈশিষ্ট্য নিয়েই তৈরি হয় ভৈরবাঙ্গ।

রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো

 

ভৈরব ঠাট:

ভৈরব বেশ প্রাচীন রাগ। সঙ্গীত-পারিজাত মতে এই রাগে ঋষভ ও পঞ্চম বর্জিত। এই মতে ভৈরব ঔড়ব জাতীয় রাগ হিসাবে। ‘রাগমালা’য় শুদ্ধ ভৈরব হিসাবে যে রাগের বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে কোমল গান্ধার ও কোমল নিষাদ-এর ব্যবহার দেখা যায়। এই বিচারে এর আরোহণ অবরোহণ ছিল– স জ্ঞ ম প দ ণ র্স – র্স ণ দ প ম জ্ঞ স। এই রাগ শুদ্ধ ভৈরব নামে পরিচিত। উল্লেখ্য বর্তমানে এই রাগের প্রচলন নাই।

এছাড় ঋষভ ও পঞ্চম বর্জিত ঔড়ব জাতীয় যে ভৈরবের সন্ধান পাওয়া যায়, তার নাম সরস্বতী ভৈরব বা আদি ভৈরব বলা হয়। পণ্ডিত ভাবভট্টের মতে জাতির বিচারে ভৈরব তিন প্রকার। প্রকার তিনটি হলো–

  • ঔড়ব (ঋষভ ও পঞ্চম বর্জিত)
  • ষাড়ব (পঞ্চম বর্জিত)
  • সম্পূর্ণ (ঠাটের কোনো স্বরই বর্জিত নয়)

রাগ ভৈরব বা রাগ ভৈঁরো বা রাগ ভায়রো

 

বর্তমানে প্রচলিত ভৈরব:

ভৈরব ঠাটের জনক রাগ। এই রাগে ভৈরব ঋষভটি অতিকোমল ঋষভ এবং আন্দোলিত হয়ে ব্যবহৃত হয়। এই রাগে ঋষভ এবং ধৈবত কোমল বাকি সকল স্বর শুদ্ধ। কোনো কোনো শিল্পী এই রাগে সুনিপুণভাবে কোমল নিষাদ ব্যবহার করে থাকেন। এ রাগের প্রকৃতি গম্ভীর। কোমল ঋষভ ও কোমল ধৈবত আন্দোলিত হয়।

ভারতীয় রস শাস্ত্রে এই রাগকে বলা হয় করুণা ও নৈরাশ্যের প্রতীক। হয়তো এক সময় ভৈরবের চলন তেমনটাই ছিল। কিন্তু বর্তমানে সকালের রাগ হিসেবে যেভাবে ভৈরব পরিবেশন করা হয়ে, তার ভিতরে থাকে গম্ভীর এবং গভীর প্রশান্তির ছায়া। এই রাগের উভয় রূপ মনকে ভক্তিমার্গে আপ্লুত করে।

ভৈরব রাগের সাধারণ পরিচিতি:

আরোহণ : স ঋ গ ম প দ ন র্স
অবরোহণ: র্স ন দ প ম গ ঋ স
ঠাট : ভৈরব
জাতি : সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ
বাদীস্বর : দ
সমবাদী স্বর : ঋ
অঙ্গ : উত্তরাঙ্গ।
গ্রহস্বর: গ
সময় : দিবা প্রথম প্রহর

পকড় : গ ম প ণদ, প, ম গ ম, ঋ স
গ ম প ণদ, ন র্স, দ, প, গ ম প গ ম ঋ স।

ভৈরব রাগে আধুনিক গান:

  • আশায় আশায় বসে আছি, ওরে আমার মন, কখন তোমার আসবে টেলিফোন [ গৌতম : মহীনের ঘোড়াগুলি ]
  • তুমি নিজের মুখেই বললে যেদিন [ প্রভাস দের সুরে গেয়েছেন মান্না দে, লিখেছেন পুলক বন্দোপাধ্যায়]
  • কতকাল দেখিনি তোমায়, একবার তোমায় দেখি। বড় সাধ জাগে [ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছেন। লিখেছেন : পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ]

 

রবীন্দ্র ভৈরব:

রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহৃত ভৈরব ও ভৈরবীর মিশ্র প্রকৃতির রাগ। ভারতীয় শাস্ত্রী সঙ্গীতে এই নামে কোন রাগের চর্চা নেই। এই রাগ সম্পর্কে ভি.ভি. ওয়াঝলওয়ার তাঁর বীন্দ্রসঙ্গীতে রাগ-নির্ণয় প্রবন্ধে যে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন, তা হলো—’রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলি ভৈরব রাগে আরম্ভ করেছেন সে-সব গানগুলির অন্তরাতে ভৈরবী রাগে প্রবেশ করেছেন এবং পুনরায় ভৈরব রাগে ফিরে এসেছেন। তাই এরূপ গানগুলির রাগকে রবীন্দ্র ভৈরব বলা হবে।’

[রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাগ-নির্ণয়। ভি.ভি. ওয়াঝলওয়ার। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান। সংগীত-শিক্ষায়তন। বৈশাখ ১৩৯০। পৃষ্ঠা : ৭৫]

এই প্রবন্ধে ‘রবীন্দ্র ভৈরব’ রাগে নিবদ্ধ গানের তালিকা, যে গানগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো হলো—

  • অলকে কুসুম না দিয়ো [প্রেম-১২৬] [তথ্য]
  • আমার এ পথ তোমার পথের থেকে [প্রেম-২৮৩] [তথ্য]
  • আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী [প্রেম-৪৩, শ্যামা] [তথ্য]
  • আমার মন কেমন করে [প্রেম-২১৪] [তথ্য]
  • আর নহে, আর নহে [প্রেম-২১০] [তথ্য]
  • ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে [প্রেম-৩০০] [তথ্য]
  • কাঁদার সময় অল্প ওরে [প্রেম-১৬৮] [তথ্য]
  • কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া [প্রেম-১৮৮] [তথ্য]
  • কোন্ দেবতা সে কী পরিহাসে [প্রেম-৩৩২] [তথ্য]
  • গানের ডালি ভরে দে গো [প্রেম-৭] [তথ্য]
  • ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি [প্রেম-৫৪] [তথ্য]
  • যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা [প্রেম-৪৬] [তথ্য]। গানটির প্রথম পঙ্‌ক্তি বসন্ত মুখারি এবং পরবর্তী অংশ রবীন্দ্র ভৈরব রাগে।

 

তথ্যসূত্র:

  • মগন-গীত ও তানমঞ্জরী, প্রথম খণ্ড। চিন্ময় লাহিড়ী। ১৪ এপ্রিল, ১৯৮৫।
  • মারিফুন্নাগমাত। রাজা নওয়াব আলী খান। অনুবাদ মকসুদুর রহমান হিলালী। বাঙলা একাডেমী, বর্ধমান হাউস জুলাই ১৯৬৭।
  • রাগ চেনা। সঙ্গীত-প্রকাশিকা। মাঘ ১৩০৮। পৃষ্ঠা: ৫১-৫২
  • রাগতরঙ্গিণী। লোচন শর্মা। সম্পাদনা ও ভাষান্তর: রাজ্যেশ্বর মিত্র। নবপত্র প্রকাশন, কলকতা। ১ বৈশাখ ১৩৯১।
  • রাগ বিন্যাস (প্রথম কলি)। শ্রীশচীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য। এস, চন্দ্র এন্ড কোং। শারদীয়া সপ্তমী, সেপ্টেম্বর ১৯৭৬।
  • রাগ-রূপায়ণ। সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যান্ড পাব্লিশাসার্স প্রাইভেট লিমিটেড। ?। পৃষ্ঠা: ৩৩-৩৫।
  • হিন্দুস্থানী সঙ্গীত-পদ্ধতি। দ্বিতীয় খণ্ড। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে। অনুবাদ ও সম্পাদনা ধরিত্রী রায় ও অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায়। দীপায়ন। ২০ কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট, কলিকাতা ৭০০০০৯।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment