আব্দুল লতিফ । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার

আব্দুল লতিফ একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশী গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো এর প্রথম সুরকার। পরবর্তীকালে তিনি নিজেও ভাষা আন্দোলনের উপর অসংখ্য গান রচনা করেছেন, তন্মধ্যে ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়, আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা ইত্যাদি সবিশেষ জনপ্রিয়।

আব্দুল লতিফ । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার

প্রারম্ভিক জীবন ও ক্যারিয়ার

আব্দুল লতিফ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর উচ্চ শিক্ষাতর্থে কলকাতায় যান। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে তিনি ১৬ বছর বয়স থেকে গান গাইতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকায় আসেন এবং পরের মাসে রেডিও পাকিস্তানের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন।

তিনি নিয়মিত বিভিন্ন মঞ্চ অনুষ্ঠানে গান গাইতেন এবং ভাষা আন্দোলনে অণুপ্রেরণা যোগাতেন। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে হিন্দু শিল্পী-গীতিকারদের দেশত্যাগের ফলে পূর্ববাংলায় বড় রকমের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ সঙ্কট-মুক্তির লক্ষ্যে তিনি আবদুল লতিফকে গান লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি প্রথমে আধুনিক গান ও পরে লেখেন পল্লিগীতি।

১৯৫২ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটিতে তিনি সুরারোপ করেন। পরবর্তীকালে গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদ এর সুরটিই টিকে আছে। তিনি তার জীবনে অসংখ্য গানে সুরারোপ করেছেন এবং কন্ঠ দিয়েছেন।

আব্দুল লতিফের মেজাজে গণসঙ্গীতের উপাদান ছিল। সেটা তাঁর প্রথম জীবনের কলকাতা-পর্বেই পরিলক্ষিত হয়। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে কোরাসে তাঁরা যেসব গান গাইতেন, তা ছিল গণসঙ্গীত। এটা ছিল তাঁর রন্ধ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। বরিশালের গ্রামীণ জীবনধারার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর মানসজগত ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। কীর্তন, পাঁচালি, কথকতা, বেহুলার ভাসান, রয়ানি গান, কবিগান, গুনাই যাত্রা, জারি-সারি, পালকির গান প্রভৃতি সঙ্গীতের সুরকে তিনি নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন। এটাই পরবর্তীকালে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁকে বিশিষ্টতা এনে দেয়।

আব্দুল লতিফ । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার

তাঁর গানগুলিতে পূর্ব-বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান-‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এ গানটিতে তিনি বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আবহ ও সুরকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গানটি পূর্ব বাংলার ঐতিহ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রতীকী গানের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।

আব্দুল লতিফ সঙ্গীতের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। বাল্যকাল থেকে গ্রামবাংলার জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, সঙ্গীতকলার সঙ্গে পরিচিত হলে তাঁর নিজের মধ্যে একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করে। উদার ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত আবদুল লতিফের সঙ্গীতে পরিস্ফুট হয় অসাম্প্রদায়িক লৌকিক গণচেতনা।

তাঁর লিখিত গান সব সংগ্রহ করা যায়নি। তবে তাঁর তিনটি গানের বই পাওয়া গেছে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে তাঁর ভাষার গান, দেশের গান। এতে আছে বাংলা ভাষা-সম্পর্কিত চবিবশটি। দেশের গান একান্নটি; পঁচানববইটি গণসঙ্গীত, দুটি জারি এবং আটটি মানবাধিকার সম্পর্কিত গান। তাঁর অন্য দুটি বইয়ের নাম দুয়ারে আইসাছে পালকি (মরমী গান) এবং দিলরবাব।

পুরস্কার ও সম্মননা

এদেশের সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের জন্য আব্দুল লতিফ ২০০২ সালে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে।

আব্দুল লতিফ । বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার

মৃত্যু

আব্দুল লতিফ ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment