নয়ীম গহর হলেন বাংলাদেশী গীতিকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জনমত গঠন ও সঙ্গীত রচনার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তাকে “স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয়।
Table of Contents
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি
নয়ীম গহর ১৯৩৭ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কলেজ জীবনেই প্রথম শ্রেণির ইংরেজি পত্রিকা ‘অবজারভার’ এ ইংরেজি কবিতা দিয়ে তিনি নিজের প্রতিভা প্রকাশ করেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একটা সময় চাকরি নিয়ে তিনি দেশের বাইরে গেলেও ফিরে এসেছেন মাটির টানে। যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন যোদ্ধা হিসেবে। আর সৃষ্টি করেছেন বহু আধুনিক ও মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়স্পর্শী গান। একজন ভালোমানের চিত্রকরও ছিলেন তিনি।সঙ্গীতশিল্পী তাজরীন গহর এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গুণী অভিনয়শিল্পী ইলোরা গহর তার কন্যা। স্ব স্ব অবস্থানে তারা খ্যাতিমান।
স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা ও সাহস জাগানো গান ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ এবং ‘নোঙর তোলো তোলো সময় যে হলো হলো’ মুক্তিকামী বাঙালির মুখে মুখে ফিরত। কালজয়ী এমনি বহু গানের গীতিকবি নয়ীম গহর। যেসব গান আজো বাঙালির হৃদয়ে মুগ্ধতা ও প্রেরণায় লেপটে আছে।
বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে বিশেষ ভূমিকা ছিল এ গীতিকবির। বরেণ্য এ গীতিকার মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপ্লব আর দেশপ্রেমের অনেক গান রচনা করে স্বাধীনতাপ্রেমী যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে মুক্তির মন্ত্রে ব্রত করেছিলেন।
বহু কালজয়ী দেশাত্মাবোধক গানের গীতিকার নয়ীম গহরের গীতিকার পরিচয়ের বাইরেও তার ছিল অনেক পরিচয়। গান লেখার পাশাপাশি একজন ঔপন্যাসিক, গায়ক, নায়ক, নাটক রচয়িতা, বিবিসির (লন্ডন) বাংলা ভাষ্যকার ও খবর পাঠক অনেক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু স্বভাবগতভাবেই তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ।
১৯৭১ সালে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তার লেখা ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘সাগর পাড়িতে ঝড় জাগে যদি’, ‘পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে’, ‘জয় জয় জয় জয় বাংলা’সহ অন্যান্য গান একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশ গড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নয়ীম গহরের। স্বাধীনতার জন্য শুধু গান রচনা করেই মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেননি, জীবন বাজি রেখে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর জরুরি বার্তা অতিগোপনে চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন নয়ীম গহর। তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগেই নিজের লেখা দেশাত্মবোধক গানগুলো গোপনীয়তার সঙ্গে রেকর্ড করেছিলেন করাচী গিয়ে।
অনেক কবিতা ও ছোট গল্প রচনা করেছেন যা বিভিন্ন সময় অনেক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। তার প্রকাশিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘শব ও স্বগতোক্তি’ এবং ‘নিষিদ্ধ বিছানা’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘রাহুগ্রাস’ নামে তার একটি গল্পগ্রন্থ রয়েছে। গুণী এই গীতিকারের অসংখ্য লেখা এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।
মৃত্যু
বরেণ্য এ গীতিকার স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে) করায় স্মৃতিশক্তি লোপ পায় এবং একই সাথে ঊরুতে একটি অস্ত্রোপচারের পর সেখানে পচন ধরায় ও দীর্ঘদিন বিছানায় থাকায় পিঠেও ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি এবং এখানেই ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর মারা যান।
পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় নয়ীম গহরকে।
আরও দেখুনঃ