বারীণ মজুমদার । বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী

‘পণ্ডিত’ বারীণ মজুমদার  ছিলেন একজন বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী। তাঁকে আখ্যায়িত করা হয় আগ্রা ও রঙ্গিলা ঘরানার যোগ্য উত্তরসাধক হিসেবে। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ২০০২ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

বারীণ মজুমদার । বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী

প্রারম্ভিক জীবন

বারীণ মজুমদার ১৯২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) পাবনা জেলার রাধানগরে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নিশেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী ও নাট্যকার; মাতা মণিমালা মজুমদার সেতার বাজাতেন।

প্রাথমিকভাবে পারিবারিক পরিমন্ডলে সঙ্গীত শিক্ষার শুরু হলেও ১৯৩৮ সালে কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছেই প্রথম রীতি অনুযায়ী সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। পুত্রের সংগীতের প্রতি আগ্রহ দেখে পিতা জমিদার নিশেন্দ্রনাথ লক্ষ্ণৌ থেকে ওস্তাদ রঘুনন্দন গোস্বামীকে নিয়ে আসেন এবং বারীণ মজুমদারের ওস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে ১৯৩৯ সালে লক্ষ্ণৌর মরিস ‘কলেজ অব মিউজিক’-এ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন এবং বি.মিউজ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৪৩ সালে তিনি মরিস ‘কলেজ অব মিউজিক’ থেকে ‘সঙ্গীত বিশারদ’ ডিগ্রি অর্জন করেন। ইতোমধ্যে তিনি কলেজের অধ্যক্ষ পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর, অধ্যাপক জে.এন.নাটু, ওস্তাদ হামিদ হোসেন খাঁ প্রমুখ সংগীতজ্ঞের কাছে তালিম নেন। পরে স্বতন্ত্রভাবে ওস্তাদ খুরশীদ আলী খাঁ, চিন্ময় লাহিড়ী, আফতাব-এ-ম্যুসিকী, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর কাছ থেকে সংগীতের তালিম নেন।

১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। ওই বছরেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি ঢাকা বেতারে নিয়মিত রাগসংগীত পরিবেশন করেছেন। ক্রিয়াপরতার সঙ্গে সৃজনশীলতার সংযোগে তিনি অধীত বিদ্যার একটি নিজস্ব পরিবেশনকলা রচনায় সমর্থ হয়েছিলেন।

বারীণ মজুমদার । বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী

বারীণ মজুমদার ১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর কাকরাইলের একটি বাসায় মাত্র ৮৭ টাকা, ১৬জন শিক্ষক এবং ১১জন ছাত্রছাত্রীর সহায়তায় দেশের প্রথম ‘কলেজ অব মিউজিক’ এর কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি রাগসংগীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ‘মণিহার সঙ্গীত একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৬৫ সাল থেকে তিনি নিয়মিত ঢাকা টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী হিসেবে রাগসংগীত পরিবেশন করতেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করে সংগীত মহাবিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজে পরিণত করেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক পরীক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭০ সালে সংগীত কলেজের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে নাজকোত-সালামত, আমানত-ফতেহ, মেহেদী হাসান, আসাদ আলী খাঁসহ বহু গুণী শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠ ও যন্ত্র শিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘আলাউদ্দিন সঙ্গীত সম্মেলন’ আয়োজন করেন।

১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের অডিশন ও সেডেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ‘একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে’ গান পরিবেশন করেন। ১৯৮২ সাল থেকে দীর্ঘ সময় তিনি সুর সপ্তক নামে একটি মাসিক পত্রিকায় সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

১৯৮৬ সালে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত লক্ষ্ণৌর ‘মরিস কলেজ অব মিউজিক’ পরিদর্শনে যান। উল্লেখ্য, এ বৎসরের ১৪ মার্চ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘মনিহার সঙ্গীত একাডেমী’ উদ্বোধন করেন পন্ডিত যশরাজ। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেন পন্ডিত ভি.জি. যোগ। ১৯৯১ সালের জুন মাসে শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

বারীণ মজুমদার । বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী

ব্যক্তিগত জীবন

বারীণ মজুমদার ইলা মজুমদারের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। ইলা একজন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। তাদের দুই সন্তান। বড় পুত্র পার্থ প্রতীম মজুমদার লব্ধপ্রতিষ্ঠ একজন মূকাভিনয় শিল্পী। কনিষ্ঠ পুত্র বাপ্পা মজুমদারও একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক।

মৃত্যু

বারীণ মজুমদার ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর বাংলাদেশের ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[৫]

সম্মাননা

সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের বেসামরিক খেতাম ‘তমঘা-ই-ইমতিয়ায’ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে তাঁকে ২১শে পদক এবং বরেন্দ্র একাডেমী কর্তৃক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তিনি ১৯৮৮ সালে বারীণ মজুমদার কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কার ও ১৯৯০ সালে সিধু ভাই স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।

বারীণ মজুমদার । বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী

১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমী তাঁকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করেন। ১৯৯৩ সালের জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ তাঁকে রবীন্দ্রপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৫ সালে বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদ তাঁকে শিল্পীশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করে। ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সম্মাননাপত্র প্রদান করেন। ১৯৯৭ সালে বারীণ মজুমদারকে বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।

১৯৯৮ সালে বারীণ মজুমদার জনকণ্ঠ গুণীজন সম্মাননা পদক লাভ করেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করে। রাগসংগীতচর্চা ও সংগীত শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে বারীণ মজুমদার বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাছাড়া তিনি সংগীত কলি ও সুর লহরী নামে দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment