মঙ্গলকাব্য ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

মঙ্গলকাব্য বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের এক অমূল্য অংশ, যা দেবতাদের মাহাত্ম্য, নৈতিক শিক্ষা, এবং ধর্মীয় ভাবনার প্রকাশ হিসেবে রচিত। মঙ্গলকাব্য হল সেই ধরনের সাহিত্য যেখানে গানের মাধ্যমে মঙ্গলকারীর, অর্থাৎ দেবতার গৌরব ও মহিমা বর্ণিত হয়। এই গানকে মঙ্গলসুরে গাওয়া হয়। যে গান মেলায় বা জনসমাবেশে পরিবেশিত হয়, সেটিকেই সাধারণত মঙ্গলকাব্য বলা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের যুগ হিসেবে পরিচিত।

মঙ্গলকাব্যের প্রতিটি গীতিকাহিনী প্রায়শই বহু পালায় বিভক্ত হয়ে রচিত হয়। এই পালাগুলি স্বতন্ত্র কাঠামো ও বিষয়বস্তু অনুসারে বিন্যস্ত। যেমন: চণ্ডী মঙ্গল, অন্নদা মঙ্গল, গণেশ মঙ্গল ইত্যাদি। প্রতিটি মঙ্গলকাব্যই একটি বিশেষ দেবতার মাহাত্ম্য তুলে ধরে।

মঙ্গলকাব্য ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

মঙ্গলকাব্যে ছন্দ ও সুরের ব্যবহার

যদিও মঙ্গলকাব্যে মঙ্গল নামক ছন্দের প্রামাণিক পরিচয় পাওয়া যায় না, তবুও বাংলা লৌকিক ছন্দ ও প্রাকৃত রীতিছন্দে এর ছায়া লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীনকালে দেববিষয়ক সকল সঙ্গীতই সাধারণত মঙ্গলসুরে গাওয়া হতো। মঙ্গলকাব্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারাবাহিকতাও দৃশ্যমান।

যেমন, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বা গীতগোবিন্দে ব্যবহৃত রাগগুলি—বসন্ত, মারার, শ্রীরাগ ইত্যাদি—মঙ্গলকাব্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। তাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো যতি, একতাল, তেওড়া, ঝাঁপতাল ইত্যাদি। যন্ত্র হিসেবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে সানাই, বাঁশি, মৃদংগ, শংখ, করতাল, রবাব, দোতারা, সেতার, ডক্ষ, খমক ইত্যাদির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

ইতিহাস ও প্রসঙ্গ

দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে তুর্কী আক্রমণ শুরু হয়। এই আক্রমণের প্রভাবের কারণে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মঙ্গলকাব্য মূলত গীতিমূলক রূপে রচিত হয় এবং পাঠ বা আবৃত্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েনি। মন্দিরা, মৃদংগ, নুপুর ও চামর ব্যবহার করে একা বা সমবেতভাবে গান পরিবেশিত হতো।

অতিপুর্বকালে পঞ্চালিকা বা পুতুলনাচের সহযোগে মঙ্গলকাব্য পরিবেশন করা হতো। এই কারণে প্রাচীন বাংলাকাব্যকে সাধারণভাবে “পাঁচালী” বলা হতো। অসম্পূর্ণ ভাষা ও অগঠিত রূপের এই কাব্যগুলি মূলত লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনায় রচিত। পরে এই পাঁচালী আকারটি পূর্ণাঙ্গ মঙ্গলকাব্যের রূপ লাভ করে।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রমাণ

মঙ্গলকাব্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার প্রামাণিক। প্রাচীন গ্রন্থ, স্থানীয় রেকর্ড ও প্রত্ননিদর্শন থেকে জানা যায়, মঙ্গলকাব্যের গানের চলন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নিয়ম অনুযায়ী ছিল। রাগ ও তালের ব্যবহার, বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণ এবং আয়োজিত পরিবেশ—সবই প্রমাণ করে যে মঙ্গলকাব্য কেবল সাহিত্যিক নয়, বরং সঙ্গীতশিল্পেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

cropped 512x512 84 মঙ্গলকাব্য ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

মঙ্গলকাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য ধারা, যা ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সঙ্গীতের সংমিশ্রণ। পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মঙ্গলকাব্য বাংলার জনগণের আধ্যাত্মিক চেতনা ও নৈতিক শিক্ষার ধারক ছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রয়োগ এটিকে কেবল সাহিত্য নয়, সঙ্গীতশিল্পেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করেছে। আজও মঙ্গলকাব্য আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে একটি স্থায়ী সেতুবন্ধন তৈরি করে।

Leave a Comment