পূর্ব বাংলার ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সুরপিয়াসী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আখতার সাদমানী। তাঁর পিতার নাম আকবর আলী এবং মাতার নাম খাদিজা বেগম। বরিশাল জেলার চাখারের বিখ্যাত খান বাহাদুর হাজী আব্দুল গণি সাহেবের দৌহিত্র সাদমানী শৈশবে দেখতে অত্যন্ত মায়াবী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই পিতার কাছে সংগীতের প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়ে সুরের প্রতি হয়ে ওঠেন প্রবল অনুরাগী। পিতার কর্মজীবনের সুবাদে শৈশব কাটে তাঁর কলকাতা শহরে।
তৎকালীন ভারতবর্ষের স্বনামখ্যাত ওস্তাদ জমীর উদ্দিন খাঁ সাহেবের সুযোগ্য শিষ্য প্রফেসর ববি ড্যানিয়েলের বেশ নামডাক। আখতার সাদমানী তখন কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জোনস স্কুলের ছাত্র। পিতার অপরিসীম আগ্রহে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রফেসর ড্যানিয়েলের কাছে হয় বালক সাদমানীর সংগীতে হাতেখড়ি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের লেখাপড়ার চেয়ে সংগীতের লেখাপড়া তাঁকে আকর্ষণ করে অনেক বেশি। ফলে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ শ্রেণির পাট চুকিয়ে সংগীতশিক্ষায় সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন তিনি। প্রফেসর ড্যানিয়েল সন্তানস্নেহে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন সাদমানীকে এবং নিয়মিত চলতে থাকে শুদ্ধ সংগীতের যথাযথ তালিম
সুদীর্ঘ এগারো বছর কঠোর সাধনার পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে গুরুজির বিশেষ আগ্রহ ও আন্তরিক সহযোগিতায় ভারতের লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থিত সুপ্রসিদ্ধ ‘মরিস’ কলেজের সম্মানিত শিক্ষক ওস্তাদ ওমর খাঁ সাহেবের শিষ্যত্ব লাভের সুযোগ পান সাদমানী। একুশ বছর বয়সের এই নবীন শিষ্যের সংগীতপ্রতিভায় অত্যন্ত মুগ্ধ হন ওস্তাদজি। নিজ পুত্রের মতো তাঁকে কাছে রেখে শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন দিক নিয়ে তালিম দিতে থাকেন একের পর এক।
ভারতীয় উপমহাদেশের সুবিখ্যাত ওস্তাদ রজ্জব আলী খাঁ সাহেবের দিক দিয়ে ওস্তাদ ওমর খাঁ এবং সংগীতভুবনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ‘ইন্দোর’ ঘরানার ধারক ও বাহক ওস্তাদ আমির খাঁ ছিলেন পরস্পর গুরুভাই । সেই সুবাদে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে খ্যাতনামা ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের একান্ত সান্নিধ্য, মহানুভবতা ও তালিম গ্রহণ করার অপূর্ব সুযোগ পেয়ে যান নিবেদিতপ্রাণ সুরসাধক আখতার সাদমানী। এরপর থেকে ওস্তাদজির পাশাপাশি তাঁর গুরুভাইয়ের কাছেও নিয়মিত সংগীতশিক্ষা এবং বিভিন্ন পরামর্শ লাভ করতে থাকেন। আর এ কারণেই ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের গায়কি এবং ওস্তাদ ওমর খাঁ সাহেবের বাজানো সরোদের কারুকাজ আখতার সাদমানীর সংগীতজীবনে প্রতিফলিত হয় বিশেষভাবে। একই সঙ্গে তাঁদের অপূর্ব ব্যবহার ও মহানুভব আচরণ সাদমানীর ব্যক্তিজীবনকেও প্রভাবিত করে দারুণভাবে।
এরপর তিনি পর্যায়ক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত ওস্তাদ আমানত আলী খাঁ, ওস্তাদ ফতেহ আলী খাঁ, ওস্তাদ মঞ্জুর হোসেন খাঁ, ওস্তাদ ফয়েজ মোহাম্মদ খাঁ প্রমুখের সাহচর্যে আসেন। বিদগ্ধ এই সংগীতগুণীজনদের কাছে খেয়াল বিষয়ে তিনি ব্যাপক তালিম গ্রহণের সুযোগ পান। কাছাকাছি সময়ে ‘ডাগর’ ঘরানার অন্যতম ওস্তাদ জহির উদ্দিন ডাগর এবং ওস্তাদ ফৈয়াজ উদ্দিন ডাগরের কাছে ধ্রুপদ বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। এভাবেই একের পর এক ভারতের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের সাহচর্য পেয়ে তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তোলেন আখতার সাদমানী।
নিবিষ্ট সংগীতচর্চা, ক্লান্তিহীন অধ্যবসায় এবং সংগীতের প্রতি অনাবিল ভালোবাসার জন্যই হয়ে ওঠেন চৌকস শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। দীর্ঘ সতেরো বছরের একনিষ্ঠ ও কঠোরতম সাধনার মধ্য দিয়ে সংগীতশিক্ষা অর্জন করে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ফিরে আসেন প্রিয় জন্মভূমিতে। পরের বছর থেকেই তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশন করতে থাকেন। শানিত সুরেলা কণ্ঠ ও চমৎকার কৌশলী গায়কির গুণে অতি অল্প সময়েই নিজ অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে নেন শাস্ত্রীয় সংগীত সমঝদার মহলে। কঠোর অনুশীলন আর নিয়মিত সংগীত পরিবেশনা চলতে থাকে বিরামহীন গতিতে। যতে দেখতেই গড়িয়ে যায় দীর্ঘ চারটি বছর।
তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে তিনি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে মাসিক চুক্তিতে যোগদান করেন। ওই বছরই বিক্রমপুরের লৌহজং কনকশাহ্ গ্রামের সংগীতশিল্পী কৃষ্ণ লাল সাহার কন্যা দীপ্তি সাহার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। নতুন সংসারে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট মা-বাবার কোল আলো করে জন্ম নেয় প্রথম সন্তান মিলি আখতার। পরের বছর ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ আগস্ট পৃথিবীর আলো দেখে বড় পুত্র আসিফ আখতার। এক কন্যা এবং এক পুত্র নিয়ে বেশ হেসেখেলে আনন্দে কেটে যায় দিনগুলি।
স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি নিদারুণ ভালোবাসা আর গানের প্রতি গভীর প্রেম নিয়ে গড়িয়ে যায় একটি বছর। দেশে তখন চলছিল তৎকালীন পশ্চিমা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি সমাজের তীব্র অসন্তোষ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নাড়া দিয়ে যায় আখতার সাদমানীর কোমল হৃদয়ে। উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী হয়েও কণ্ঠে তুলে নেন তিনি গণসংগীতের মারাত্মক হাতিয়ার। উদ্দীপনামূলক গানের ঝংকারে পশ্চিমা শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা ঝরে পড়ে শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে। স্বাধিকার আদায়ে একাত্ম হন আপামর জনতার কাতারে। পরের বছর ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন জন্মগ্রহণ করে দ্বিতীয় পুত্র আমিন আখতার সাদমানী (ছোটকা)।
দিন দিন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে। অসহযোগ আন্দোলন, পশ্চিমা বেনিয়া শাসকগোষ্ঠীর চোখরাঙানি, বিবৃতি পাল্টাবিবৃতি, থমথমে পরিবেশ – সবকিছু মিলে মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে শিল্পী আখতার সাদমানীর। এরই মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পরের বছর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগস্ট সংগীত প্রযোজক পদে বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন শিল্পী আখতার সাদমানী। বেতারে কর্মরত অবস্থায় অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশন করে শাস্ত্রীয় সংগীতের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তাঁর কণ্ঠে রেকর্ডকৃত অসংখ্য খেয়াল এখনো শাস্ত্রীয় সংগীতের উচ্চ মর্যাদার ধারা বহন করে চলেছে।
দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনা করেছেন সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আখতার সাদমানী। বেতারে তিনি একুশের গান, স্বাধীনতার গান, দেশের গান, ইসলামী গান, পল্লীগানসহ অসংখ্য আধুনিক গানের সুর সৃষ্টি এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর দক্ষ সুর সংযোজনা ও সংগীত পরিচালনায় একুশের গীতিনকশা ‘অহংকারের বর্ণমালা’, স্বাধীনতার গীতি আলেখ্য ‘বিজয়ের পতাকা উড়ছে ঐ’, ঈদুল ফিতরের গীতিনকশা ‘আজকে খুশির ঈদ’, ঈদুল আজহার গীতিনকশা ‘ত্যাগের মহান মিনার জুড়ে’, মহররমের গীতিনকশা ‘কারবালা’, ‘তপ্ত ফোরাতে’ এবং ‘ফোরাতের তীরে’, নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ গীতিনকশা ‘ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে ও ‘জনম জনম গেল’, গ্রামবাংলার উৎসবের গীতি আলেখ্য ‘হাজার নদীর গান মধুমতি’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সংগীত নিয়ে ঈর্ষণীয় সফলতা আর ব্যক্তিজীবনের পরিপূর্ণতায় বেশ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ দিনের বেলা অপঘাতে স্ত্রীবিয়োগ ঘটলে দারুণ মানসিক আঘাতে ভেঙে পড়েন ওস্তাদ সাদমানী। আচমকা যেন থেমে যায় তাঁর রুটিন বাঁধা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। নিদারুণ ব্যথায় মেঘাচ্ছন্ন থমথমে হয়ে পড়ে তাঁর সুরের আকাশ। অপরিণত বয়সের সন্তানদের নিয়ে যেন দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। পুত্র সাদমানীর নিদারুণ মানসিক ভগ্নদশায় মা খাদিজা বেগমও হয়ে পড়েন অত্যন্ত বিচলিত। অবশেষে মায়ের মমতাপূর্ণ অনুরোধে ও পারিবারিক চাপে পড়ে আবারো পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে রাজি হন ওস্তাদজি। পারিবারিক আয়োজনে নভেম্বর মাসে মরহুম গাজী ইলিয়াস সাহেবের কন্যা রহিমা খাতুন ওরফে রানু আখতারের সঙ্গে বিবাহ-উত্তর সংসার শুরু করেন।
শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে আরো বেশি মনোনিবেশ করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রচার ও প্রসারে। শুদ্ধ সংগীতশিল্পী সৃষ্টির মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ‘সুর রং অ্যাকাডেমি অব ক্লাসিক্যাল মিউজিক’ নামে একটি শুদ্ধ সংগীত শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন ওস্তাদ আখতার সাদমানী। সংগীত শিক্ষকতার সুদীর্ঘ ৩৪ বছর দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় বহু শিক্ষার্থীকে শুদ্ধ সংগীতচর্চার সুষ্ঠু পথ দেখিয়েছেন এই মহান সুরসাধক। অগণিত সংগীতানুরাগী ও দেশবরেণ্য সংগীতপ্রতিভা তাঁর কাছে শুদ্ধ সংগীতের তালিম লাভ করে হয়েছেন ধন্য।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, শবনম মুশতারী (একুশে পদকপ্রাপ্ত), ফাতেমা-তুজ-জোহরা (একুশে পদকপ্রাপ্ত), পাপিয়া সারোয়ার, শম্পা রেজা, অধ্যাপক ডক্টর নাশিদ কামাল, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, অধ্যাপক শামীমা পারভীন বাবু (অধ্যক্ষ, সরকারি সংগীত কলেজ, ঢাকা), সুজিত মোস্তফা, নার্গিস পারভীন, সাবিহা মাহবুব, এম এ মান্নান, পারভীন মুশতারী, ইয়াসমীন মুশতারী, মো. ইব্রাহীম, দীপ্তি রাজবংশী, অধ্যাপক জহির আলীম (সরকারী সংগীত কলেজ, ঢাকা), নিগার সুলতানা, কাজী রুবিনা আহমেদ মিলি, এ কে এম শাহজাহান পাটোয়ারী, ডক্টর লীনা তাপসী খান (সহকারী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), জোসেফ কমল রড্রিক্স, কনক চাঁপা, অনিমা লিজা ডি কষ্টা, আঁখি আলমগীর প্রমুখ স্বনামখ্যাত শিল্পী বিভিন্ন সময় তাঁর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন।
শুদ্ধ সংগীতের প্রচার ও প্রসারের মহান দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ওস্তাদ আখতার সাদমানীর গাওয়া ছয়টি রাগের ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতের (খেয়াল) তিনটি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। ক্যাসেট তিনটির ভলিয়াম: ১-এ রাগ ‘দরবারি কানাড়া ও ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’, ভলিয়াম : ২-এ রাগ ‘মালকোষ’ ও ‘আভোগী কানাড়া’ এবং ভলিয়াম : ৩-এ ‘কৌশিক কানাড়া’ ও ‘আহির ভায়রো রাগে খেয়াল বাণীবদ্ধ হয়। শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চাকারী শিল্পীদের কাছে ওস্তাদজির কণ্ঠে রেকর্ডকৃত উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্যাসেটসমূহ এক অনন্য সম্পদ হিসেবে প্রতীয়মান।
দেশবরেণ্য উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী ও প্রশিক্ষক ওস্তাদ আখতার সাদমানী ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণির তালিকাভুক্ত উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী। বিটিভিতে তাঁর পরিকল্পনা গ্রন্থনা, উপস্থাপনা এবং পরিচালনায় ‘সুর ও ছন্দ’ নামে উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষার একটি সমৃদ্ধ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় দীর্ঘদিন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উচ্চাঙ্গসংগীত প্রশিক্ষণ কর্মশালা’র একজন সম্মানিত অতিথি প্রশিক্ষক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আয়োজন করেছিল তিন দিনব্যাপী ‘উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলন’। সেই সম্মেলনে তিনি ‘মালকোষ রাগে খেয়াল’ পরিবেশন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন।
এই বছরই (১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে) ভারতের স্বনামখ্যাত সংগীতগুণীজন ওস্তাদ এনায়েত খাঁ সাহেবের সুযোগ্য শিষ্য এবং বর্ধমান মিউজিক অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ প্রফেসর ধ্রুবতারা যোশী (ডি.টি. যোশী) তাঁর স্নেহাস্পদ ছাত্রী অভিনয় ও সংগীতশিল্পী শম্পা রেজার অনুরোধে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। এই সময়ে অপর স্নেহধন্য ছাত্রী সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ারের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে প্রফেসর যোশীর সঙ্গে দেখা করেন ওস্তাদ আখতার সাদমানী। স্ত্রীর অকাল বিয়োগের করুণ কাহিনি এবং ওস্তাদজির হৃদয়ের ব্যথা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন প্রফেসর যোশী।
পরম মমতায় তিনি ওস্তাদ সাদমানীকে আলিঙ্গন করেন এবং তাঁর গলায় গভীর চুম্বন করে সুরের অমিয়ধারায় বারবার সিক্ত হতে পরামর্শ দেন। বাসায় ফিরে পুত্র ছোটকাকে (আমিন আখতার সাদমানী) তবলা-বাঁয়া নামাতে নির্দেশ দিয়ে নিজে তানপুরায় সুর বেঁধে আপন মনে গাইতে শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ধরে পাগলের মতো গান করতে থাকেন একের পর এক। সেইসঙ্গে দুনয়ন বেয়ে তাঁর ঝরতে থাকে বেদনার বারিধারা। সিক্ত হয়ে যায় বসন, প্রতিবেশীরা এসে বাড়ির দরজা-জানালায় ভিড় জমিয়ে ফেলে। একনাগাড়ে তবলায় সংগত করতে করতে সদ্যযুবা পুত্র আমিনের দুহাত ও মুখ লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো দিকেই কোনো খেয়াল নেই ওস্তাদজির। সুরের সমুদ্রে ভেসে কষ্টের নোনাজল ঝরিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে যেন তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
![ওস্তাদ আখতার সাদমানী [ Ustad Akhtar Sadmani ] 4 YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 ওস্তাদ আখতার সাদমানী [ Ustad Akhtar Sadmani ]](https://sp-ao.shortpixel.ai/client/to_auto,q_glossy,ret_img,w_160,h_120/https://bn.musicgoln.com/wp-content/uploads/1965/12/YaifwwriN4BzRFCyqbslL4-300x225.png)
চাকরিজীবনে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই তিনি উপমুখ্য সংগীত প্রযোজক পদোন্নতি লাভ করেন। দুবছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ৯ আগস্ট ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে মুখ্য সংগীত প্রযোজক পদে আসীন হন ওস্তাদ আখতার সাদমানী। মনের দিক থেকে চির তরুণ, শুদ্ধ সংগীতসাধক ও শিল্পী গড়ার মহান এই কারিগর তাঁর বর্ণাঢ্য চাকরিকাল অতিবাহিত করে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্র থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
পৃথিবী বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের সাহচর্যে ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত শাস্ত্রীয় সংগীতশিক্ষা লাভ করে মনেপ্রাণে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন শুদ্ধ সংগীতের সাধকপুত্র রূপে। তাই তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগীতের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা মিশে ছিল তাঁর প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে।
বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচার, প্রসার, বিকৃতি রোধ ও শুদ্ধ সংগীতচর্চায় ওস্তাদজির নিরলস প্রচেষ্টা চির-উজ্জ্বল হয়ে থাকবে সংগীত ইতিহাসের পাতায় পাতায়। শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চায় যে অবদান তিনি রেখে গেছেন দেশের শিল্পীসমাজকে তা করেছে চিরঋণী।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষার আসর ‘সুর ও ছন্দ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রশিক্ষণ শেষে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর প্রাইভেট কারযোগে উত্তরার নিজ বাসভবনের উদ্দেশে রওনা করেন ওস্তাদজি। চলন্ত গাড়িতে আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয় এবং শুদ্ধ সংগীতের মহান সাধকপুরুষ ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অনন্ত সুরালোকের পথে যাত্রা করেন।
শিল্পকলায় (সংগীত বিষয়ে) অনন্য অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত ওস্তাদ আখতার সাদমানীকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করে।