মান্না দে । বাঙ্গালী সংগীত শিল্পী এবং সুরকার

প্রবোধ চন্দ্র দে, ডাকনাম মান্না দে, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সংগীতশিল্পী ও সুরকারদের একজন ছিলেন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি সহ প্রায় ২৪টি ভাষায় ষাট বছরেরও বেশি সময় তিনি সংগীত চর্চা করেছেন। আলিপুরদুয়ারে তাঁর গুণগ্রাহী দেবপ্রসাদ দাস তাঁর নিজ বাড়িতে মান্না দে সংগ্রহশালা স্থাপন করেছেন। বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত জগতে তাঁকে ভারতীয় গানের বিশ্বে সবকালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উত্তর কলকাতায় তাঁর বাসস্থানের কাছে তাঁর মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।

মান্না দে গায়ক হিসেবে আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সফল সংগীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে তিনি বিশাল খ্যাতি অর্জন করেন। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ভারতীয় চলচ্চিত্রে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। সংগীতজীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেন। তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননা প্রদান করে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ পদক প্রদান করে।

মান্না দে । বাঙ্গালী সংগীত শিল্পী এবং সুরকার

মান্না দে’র জন্ম ১ মে ১৯১৯ সালে পূর্ণ চন্দ্র ও মহামায়া দে দম্পতির ঘরে হয়। পিতৃ পক্ষের সর্বকনিষ্ঠ কাকা, সঙ্গীতাচার্য কে.সি. দে (কৃষ্ণ চন্দ্র দে) তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেন। শৈশবে ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামের একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, পরে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। কলেজ জীবনে তিনি সহপাঠীদের সামনে গান গেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন। কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং উস্তাদ দাবির খান থেকে গান শেখেন। আন্তঃকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় তিন বছর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

প্রথম জীবন

১৯৪২ সালে মান্না দে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সঙ্গে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) আসেন। প্রথমে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন, পরে শচীন দেব বর্মণ (এস.ডি. বর্মণ) এর অধীনে কাজ করেন। তারপরে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন। এই সময় হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন উস্তাদ আমান আলি খান ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খান থেকে।

প্রাথমিক পেশাগত জীবন

‘তামান্না’ (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে, যেখানে সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈত গানে অংশগ্রহণ করেন। শচীন দেব বর্মণের ‘মশাল’ (১৯৫০) ছবিতে ‘ওপার গগন বিশাল’ গানটি গেয়ে জনপ্রিয়তা পান। কবি প্রদীপের রচিত এই গান তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৫২ সালে বাংলা ও মারাঠি চলচ্চিত্রে ‘আমার ভূপালী’ গান গেয়ে জনপ্রিয় হন।

মান্না দে ভীমসেন জোশির সঙ্গে ‘কেতকী গুলাব জুহি’ নামক জনপ্রিয় দ্বৈত গান গেয়েছেন। কিশোর কুমারের সঙ্গে ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ (শোলে) ও ‘এক চতুর নার’ (পডোসন) গানগুলোও প্রসিদ্ধ। গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলা ছবিতে বহু গান গেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈত গানে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ (শঙ্খবেলা) গান গেয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতসহ মোট প্রায় ৩৫০০ গান গেয়েছেন। তিনি অসংখ্য শ্যামাসংগীতের গাওয়ানও ছিলেন।

পারিবারিক প্রেক্ষাপট

কেরলের মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন মান্না দে। তাদের দুই কন্যা রয়েছে, সুরমা ও সুমিতা। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর জীবনের শেষ পর্যায়ে বেঙ্গালুরুর কালিয়ানগর এলাকায় বাস করেছিলেন। এছাড়া তিনি কলকাতাতেও ছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি সঙ্গীত বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছিলেন।

মৃত্যু

২০১৩ সালের ৮ জুন ফুসফুসের জটিলতায় বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি হন মান্না দে। ৯ জুন তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসকরা তা দ্রুত অস্বীকার করেন এবং জানান তিনি তখনও বেঁচে আছেন, তবে অবস্থার অবনতি হয়েছে এবং নতুন কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে তার অবস্থা কিছুটা উন্নতির খবর দেন চিকিৎসকরা। ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে বেঙ্গালুরুতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

আত্মজীবনী ও রবীন্দ্র ভারতীর উদ্যোগ

২০০৫ সালে আনন্দ প্রকাশনী থেকে বাংলায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘Memories Come Alive’, হিন্দিতে ‘Yaadein Jee Rahi’ এবং মারাঠি ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুবাদিত হয়েছে। মান্না দে’র জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্না দে সঙ্গীত একাডেমী তার সম্পূর্ণ আর্কাইভ সংরক্ষণ ও বিকাশ করছে। এছাড়া, কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত ভবনে তার সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

জনপ্রিয় গানসমূহ

  • কফি হাউজের সেই আড্ডাটা
  • আবার হবে তো দেখা
  • এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি
  • তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়
  • যদি কাগজে লেখো নাম
  • সে আমার ছোট বোন
  • শাওন রাতে যদি

সাফল্য এবং খ্যাতি

মান্না দে পদ্মশ্রী এবং পদ্মবিভূষণ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেছেন। ২০১১- ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মান প্রদান ২০১১- পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ প্রদান। ২০১২- তার কৃতিত্বের জন্য ২৪ ঘণ্টা টিভি চ্যানেল আজীবন অনন্যা সম্মান প্রদান করে।

Leave a Comment