রাগ কেদার বা কেদারা উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী রাগ। এর সুরের সৌন্দর্য ও অভিব্যক্তি এতই গভীর যে, শ্রোতার মনে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তির আবেশ সৃষ্টি করে। শান্ত প্রকৃতির এই রাগ মূলত রাত্রির প্রথম প্রহরে পরিবেশনের জন্য উপযোগী এবং প্রাচীনকাল থেকে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আসছে।
Table of Contents
মূল বৈশিষ্ট্য
বৈশিষ্ট্য | বর্ণনা |
---|---|
ঠাট | কল্যাণ |
জাতি | ঔড়ব-সম্পূর্ণ (অর্থাৎ আরোহণে পাঁচ স্বর, অবরোহণে ছয় স্বর ব্যবহৃত) |
আরোহণ | স ম গম প ধপ নধ র্স |
অবরোহণ | র্স ন ধ প, হ্মপ ধপ, ধম, র স |
বাদী স্বর | মধ্যম |
সমবাদী স্বর | ষড়্জ |
অঙ্গ | পূর্বাঙ্গ প্রধান |
গান্ধার | গুপ্ত, বক্র ও দুর্বল প্রয়োগ |
মধ্যম | উভয় (শুদ্ধ এবং তীব্র মধ্যম) ব্যবহৃত হয় |
প্রকৃতি | শান্ত ও মৃদু |
সময় | রাত্রি প্রথম প্রহর (সন্ধ্যার পর) |
পকড় | স ম, মগম, প, হ্মপ, ধম, সর, স |
রাগের গঠন ও চলন
রাগ কেদারে আরোহণ এবং অবরোহণে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর আরোহণে ঋষভ (র) ও নিষাদ (নি) স্বর বাদ দেওয়া হয়, ফলে সুরের মধ্যে একটি সরল ও প্রশান্ত ধারা বজায় থাকে। অপরদিকে, অবরোহণে সব স্বর ব্যবহৃত হয়, তবে গান্ধার (গ) স্বরের প্রয়োগ গুপ্ত, বক্র এবং দুর্বল, যা রাগটিকে রহস্যময় করে তোলে।
মধ্যম স্বরটি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উভয় মধ্যমের (শুদ্ধ ও তীব্র) সংযোজন রাগটির স্বাদে বৈচিত্র্য ও মাধুর্য এনে দেয়। বিশেষত, পকড়ে মধ্যম ও পঞ্চমের মিলনে রাগের আত্মা ধরা পড়ে।
রাগ কেদারের সুর-প্রবাহ
রাগ কেদারে সুরপ্রবাহ নিরীক্ষণের সময় লক্ষ্য করা যায়, এটি সহজাত শান্তির আবহ তৈরি করে। এর পকড় — “স ম, মগম, প, হ্মপ, ধম, সর, স” — রাগের মূর্ত রূপ প্রকাশ করে। মধ্যম ও পঞ্চমের আশ্রয়ে সুরের আলাপ ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে, ধৈবত ও নিষাদের সহায়ক ভূমিকা রাগের সৌন্দর্য বাড়ায়।
শ্রবণ অভিজ্ঞতা
বিশিষ্ট শিল্পীরা রাগ কেদারের পরিবেশনে অতুলনীয় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ওস্তাদ আমির খান, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, এবং পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর পরিবেশনায় রাগ কেদার নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাঁদের গাওয়া রাগ কেদারের আলাপ এবং খেয়াল শ্রোতাদের কাছে এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।
রাগ কেদারের মধ্যে এমন এক সহজিয়া, স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্য রয়েছে যা সন্ধ্যার গভীরতা এবং মননশীলতা উভয়কেই স্পর্শ করে।
সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ
রাগ কেদারের নামকরণ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, এটি হিমালয়ের পবিত্র কেদারনাথ মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত, যা আধ্যাত্মিক শান্তির প্রতীক। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটি একটি প্রাচীন ধ্রুপদী রাগের পরিবর্তিত রূপ। যে যাই বলুক, রাগ কেদার তার নির্মল সৌন্দর্য ও অনন্য ব্যাকরণ দিয়ে যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
রাগ কেদার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
রাগ কেদারের পরিবেশনে অলঙ্কার (আলঙ্কারিক চলন) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাগের মূখ্য আবহ ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয় — আকস্মিক পরিবর্তন বা দ্রুত ছন্দবদল রাগের সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারে।
মৃদু গতি (মন্দ লয়) থেকে শুরু করে দ্রুততর গতি (দ্রুত লয়) পর্যন্ত চলতে পারে, তবে গম্ভীরতা বজায় রেখে।
🎵 রাগ কেদারে কম্পোজ করা কিছু বিখ্যাত গান ও রচনার তালিকা
গান / রচনা | শিল্পী | ধরণ |
---|---|---|
“Poocho Na Kaise Maine Rain Bitai” | মানা ডে | হিন্দি ক্লাসিক্যাল ঘরানার সঙ্গীত |
“Madhuban Mein Radhika Nache Re” | মোহাম্মদ রফি | হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীত (ক্লাসিক্যাল ভিত্তিক) |
“Bho Shambho” | পণ্ডিত দীনকর কৌল | ভক্তিমূলক সঙ্গীত |
“Gopala Gopala Devaki Nandana Gopala” | এম.এস. সুব্বুলক্ষ্মী | কর্ণাটকী ভজন (কিন্তু রাগ কেদার সংলগ্ন ধাঁচে) |
“Sur Sangam” (Instrumental, Kedar) – সেতার রেন্ডিশন | পণ্ডিত রবিশঙ্কর | যন্ত্রসঙ্গীত |
“Shankara Girijaapati” | পণ্ডিত ভীমসেন যোশী | খেয়াল (উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত) |
“Shuddha Kalyan Bhajans” (সন্নিহিত কেদার রূপে) | ওস্তাদ আমির খান | খেয়াল ভিত্তিক ভজন |
“Mera Aapki Kripa Se” | জগজিৎ সিং | আধুনিক ভজন (আংশিক কেদার সংলগ্ন প্রয়োগ) |
✨ উল্লেখযোগ্য পরিবেশনা
ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের কেদারে পরিবেশিত দারুণ সব খেয়াল আজও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ইতিহাসে স্মরণীয়।
পণ্ডিত যশরাজ তাঁর কেদার পরিবেশনায় অত্যন্ত গভীর রসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
কিশোরী আমোণকর তাঁর কেদার পরিবেশনায় এক অপূর্ব গাম্ভীর্য ও কোমলতার সমন্বয় দেখিয়েছেন।
📌 কিছু বিখ্যাত ধ্রুপদ রচনাও আছে রাগ কেদারে, যেমনঃ
“Ab More Bihari”
“Kari Badariya Barasat Jaaye”
(এগুলো মূলত ধ্রুপদ বা ধমার ঘরানার রচনা)
🎶 বিশেষ দ্রষ্টব্য
রাগ কেদার এবং রাগ শুদ্ধ কল্যাণ কখনো কখনো শ্রবণে মিল খায়, কারণ উভয় রাগে কল্যাণ ঠাটের প্রভাব রয়েছে। তবে কেদারের স্বরচারণ ও পকড় আলাদা করে দেয় তার নিজস্ব পরিচয়।

রাগ কেদার হলো সৌন্দর্য, নির্মলতা এবং আধ্যাত্মিকতার এক অপরূপ মেলবন্ধন। যারা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রেমিক, তাঁদের সুরসাধনায় রাগ কেদার এক অপরিহার্য অধ্যায়। তার সরলতায় মিশে থাকা সূক্ষ্ম জটিলতা এবং শান্ত প্রকৃতি শ্রোতার মনে এক অনন্ত প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি করে।
তথ্যসূত্র
উচ্চাঙ্গ ক্রিয়াত্মক সঙ্গীত, শক্তিপদ ভট্টাচার্য, নাথ ব্রাদার্স, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭।
রাগ বিন্যাস (প্রথম কলি), শ্রীশচীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য, এস চন্দ্র এন্ড কোং, শারদীয়া সপ্তমী, সেপ্টেম্বর ১৯৭৬।
অনলাইন গবেষণা ও বিভিন্ন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধ ও শ্রবণ অভিজ্ঞতা।
আরও দেখুন: