অতি প্রাচীনকালে আমাদের দেশে ওঁ ধ্বনি সহযোগে সংগীতের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই সংগীতের ভিত্তি ছিল আধ্যাত্মিকতা, বিষয় ছিল পরমেশ্বরের আরাধনা এবং বিশ্বপ্রকৃতির বন্দনা, আর উদ্দেশ্য ছিল আত্মোন্নতি তথ্য ঈশ্বরলাভ। সেই সংগীতের রূপ, রস, অলৌকিকতা প্রভৃতি সম্পর্কে গবেষকেরা নানাবিধ বর্ণনা ও আলোচনা করেছেন। সেই সকল আলোচনাদিতে কোন কোন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এ বিষয়ে সকলেই একমত যে তৎকালীন সংগীতানুষ্ঠানাদির সঙ্গে আর্থিক কোন যোগ ছিল না। তা ছিল পুরোপুরি পারমার্থিক।
রামায়ণ মহাভারত তথা অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থাদিতে তৎকালীন অনুষ্ঠানাদির প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বহু বিচিত্র সংগীতানুষ্ঠানের উল্লেখ থাকায়, সংগীত যে তখন, অর্থাং খৃষ্টীয় শতাব্দীর বহু পূর্ব থেকেই অতি উচ্চ-কলাবিদ্যারূপে স্বীকৃত এবং প্রাচীন ভারতীয় সামাজিক অনুষ্ঠানাদির অপরিহার্য সঙ্গ ছিল সে কথা জানা যায়।
আমাদের শাস্ত্রাদিতে সংগীতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে উল্লিখিত উক্তিসমূহ উক্ত অভিমত সমর্থন করে। অতএব এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রাচীন ভারতে সংগীতের মর্যাদা ছিল ঐতিহ্যময় এবং তার ভিত্তি ছিল আধ্যাত্মিকতা। যুগপ্রবাহে তার নানা রূপবিবর্তন ঘটলেও ভারতীয় সংগীতসাধনায় আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি চিরদিনই প্রধান ৷
সঙ্গীতকে সাধারণভাবে আধ্যাত্মিক বা আত্মোন্নতি, লোকরঞ্জন, অর্থোপার্জন প্রভৃতি নানা পর্যায়ভুক্ত করা যায়। কারণ এর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্রমবিবর্তিত হয়েই চলেছে। দরবারী সংগীতের প্রথম সংবাদ পাওয়া যায় মহারাজ সমুদ্র গুপ্তের রাজত্বে। তিনি স্বয়ং অতিগুণী সংগীতজ্ঞ (বীণাবাদক) ছিলেন।
দরবারী সংগীতের চরম বিকাশ হয় মধ্যযুগে। তবে লোকরঞ্জন এবং অর্থোপার্জনই ছিল তার মূলগত উদ্দেশ্য। সুতরাং সংগীত আধ্যাত্মিক তথা শ্রেষ্ঠ কলাবিদ্যা এই মূল্যায়নের আদর্শ আপাতত গ্রন্থাদিতেই সীমিত, এমন কথা বলা বোধ করি অসঙ্গত নয়। কারণ সাধকের কঠোর সাধনা এবং নিষ্ঠার প্রকাশ প্রায় দুর্লভ হয়ে চলেছে।
বর্তমানে সংগীতচর্চা তথা শিক্ষার প্রসার দ্রুত বেড়ে চলেছে। স্কুল-কলেজে পাঠ্যতালিকার অন্তভুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় সাধারনের সংগীতরুচি কতটুকু উন্নত হয়েছে, সে কথা চিন্তার বিষয়। অবশ্য এই অভিমত শুধুমাত্র উত্তর ভারতীয় সংগীতের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, দক্ষিণ ভারতের সংগীত চিরদিনই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
সেখানকার ভৌগোলিক পরিস্থিতি, রীতিনীতি, ভাষা প্রভৃতি বহুবিধ কারণে নানা বিবর্তনের মধ্যেও প্রাস্তীয় কৌলীন্য রক্ষা পেয়েছে। তাই প্রাচীন ভারতীয় সংগীতরূপের আভাষ কিছু পরিমাণে কর্ণাটক সংগীতেই বিদ্যমান ।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘সংগীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে বলেছেন,
“যে লোক মাঝারি সে তার মাঝখানের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে সন্তুষ্ট থাকে না, সে প্রমাণ করতে চায় সেই যেন উপরওয়ালা। উত্তমের বিনয় স্বাভাবিক, অধমের বিনয় দায় পড়িয়া, কিন্তু জগতে সবচেয়ে দুঃসহ ঐ মধ্যম।” আমাদের দেশে গুণীজনের অভাব নেই, কিন্তু দেশের প্রায় সর্বক্ষেত্রের মত সংগীতের ক্ষেত্রেও মাঝারির প্রভুত্বের প্রাদুর্ভাব দুর্বার হওয়ায় তারা অসহায় বোধ করেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের আদর্শহীন তার পরিচয় দিতে হয় এবং চটুল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সস্তা বাহবার প্রতি আগ্রহী হতে দেখা যায়। বিষয়টি মর্মাস্তিক এবং বিবেচনার দাবী রাখে। কিন্তু আমাদের অবস্থা হোল—“নাহি জানে কার দ্বারে দাড়াইবে বিচারের আশে।”
গুণীজনের আদর্শহীনতার আর একটি কারণ হোল, তাদের মননশীলতার অভাব। পণ্ডিত ভাতখণ্ডে সংগীতজ্ঞদের চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যেমন, ‘কলাকার’ ‘শাস্ত্রকার’ ‘গীতিকার’ ও ‘শিক্ষক’। এর সবগুলি বিভাগে বিচক্ষণ সংগীতজ্ঞ কদাচিৎ মেলে। অবশ্য এর কোন একটি বিভাগে পারদর্শ হওয়াও সহজ নয়। তবে তেমন গুণীজন আমাদের দেশে বহু আছেন। কিন্তু সকল সংগীতজ্ঞেরই কিছুটা অন্তত জ্ঞান এর সবগুলি শাখাতে থাক। অবশ্য কর্তব্য। কারণ নিরক্ষর কলাকার, স্বরজ্ঞানহীন শাস্ত্রকার, সংগীতজ্ঞানহীন গীতিকার এবং অরসিক তথা শাস্ত্রজ্ঞানহীন শিক্ষক এঁরা সকলেই প্রায় অঙ্কের মতো সংগীতসমুদ্রের তীরে বসে হাহুতাশ করে থাকেন।
কিছুকাল আগে এক সংগীতানুষ্ঠানে কিছু বিদেশী শিল্পীর গান শুনেছিলাম । তার৷ ভারতীয় রাগ-সংগীত এবং রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। তাঁদের উদাত্ত কণ্ঠস্বর, সাবলীল গায়কী এবং সাধনার নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভারত সরকার বিদেশে ভারতীয় সংগীত প্রচারে যত্নশীল। বিদেশীরাও পরম আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। হয়তো এমন দিন আসবে যখন আমাদের দেশের অন্যান্য বিঘার মতো সংগীতের পরিচয় নিতেও আমাদের বিদেশে যেতে হবে।
আমাদের জাতীয় ত্রুটি হোল যে, আমাদের সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতার অস্ত নেই। আমরা মনে করি, আমাদের সংগীত ও সংস্কৃতি চরম প্রগতিশীল, এবং আমরা পরম সংস্কৃতিবান অথচ বিদেশী চটুল সংগীত ও সংস্কৃতির প্রতি চট করে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমরা বহু বিচিত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতির নামে যা অনুষ্ঠিত হয়, তাকে অত্যাচার বললেও কম বলা হয়। কোথাও তা শুধুমাত্র সৌখিন আমোদের বিষয়। কেহ বা ইংরেজি শিক্ষা বা অর্থের জোরেই নিজেকে উত্তম সমঝদার বলে জাহির করে খুশি হন।
আমাদের সংগীত ও সংস্কৃতির ভূমিকা আজ কোথায় সে বিষয়ে বিবেচনার অবকাশ আছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই শক্তিমান গুণীজনের হস্তক্ষেপ এবং সাধারণের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করি। আর এই সব ত্রুটি বিচ্যুতি সংশোধনে আমাদেরই আগ্রহশীল ও সচেষ্ট হতে হবে।