হস্স্সু খাঁ ও হদ্দু খান

হস্স্সু খাঁ ও হদ্দু খান : হসু খাঁ ও তাঁর ভাই ওস্তাদ হদ্দু খাঁ ছিলেন গোয়ালিয়র ঘরানার প্রখ্যাত গায়ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই সংগীতগুণী দুই ভাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পিতা কাদির বখস এবং পিতামহ নখন পীর বখস হিন্দুস্তানি সংগীতজগতে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। হসু ও হদু খাঁ অল্প বয়সে পিতাকে হারান। ফলে পিতামহের আশ্রয়েই দুই ভাই গোয়ালিয়রে লালিত-পালিত হন।

হস্স্সু খাঁ ও হদ্দু খান

হস্স্সু খাঁ ও হদ্দু খান

এসময় গোয়ালিয়রের অধিপতি ছিলেন মহারাজা দৌলতরাও সিন্ধে। তাঁর দরবারে তখন সভাগায়ক ছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান খেয়াল গায়ক ওস্তাদ মুহম্মদ খাঁ। হসু খাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অপূর্ব। মহারাজ সিন্ধে হসু ও হুদ্দুকে মুহম্মদ খাঁর গান গোপনে শোনার ব্যবস্থা করে দেন। কারণ পুরনো গোষ্ঠী বিবাদের জন্য মুহম্মদ খাঁ কিছুতেই তাঁদের সংগীতশিক্ষা দিতে রাজি ছিলেন না। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ঐশ্বরিক গায়নক্ষমতার অধিকারী হসু ও হদ্দু খাঁ ওস্তাদ মুহম্মদ খাঁর গায়কি আয়ত্ত করে ফেলেন। এরপর মহারাজ দৌলতরাও একদিন তাঁর দরবারে জলসার আয়োজন করেন। সেখানে দুই ভাই তাঁদের প্রতিভার পরিচয় দিয়ে উপস্থিত সকলকে চমৎকৃত করেন। এতে মুহম্মদ খাঁ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন।

এরপর মুহম্মদ খাঁ হসু ও হদ্দু খাঁর ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। খুব দ্রুত এক সুযোগ জুটে যায়। পরবর্তী সময়ে আরেকটি জলসার আয়োজন করা হলে মুহম্মদ খাঁ চক্রান্ত করে হসু খাঁকে ‘মিয়াকি মালহার’ গাইতে অনুরোধ করেন। সরল স্বভাবের হসু খাঁ কোনো কিছুর বিপদ আশঙ্কা না করে গান ধরেন। এই গানে তাঁর প্রতিপক্ষ ওস্তাদরা ‘কড়ক বিজলি’ নামে এক প্রকার কঠিন তান প্রয়োগ করেন। হসু খাঁ তাৎক্ষণিকভাবে দ্বিতীয়বার ওই তান প্রয়োগ করেন। কিন্তু এর ফলে অতিরিক্ত দম রাখার জন্য তাঁর বুকে আঘাত লাগে এবং মুখ দিয়ে রক্তবমি হতে থাকে। এই আঘাতের কিছুকাল পরে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে হসু খাঁর মৃত্যু হয়। তরুণ বয়সেই এক প্রতিভাবান গায়কের জীবনাবসান হয়।

 

YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 হস্স্সু খাঁ ও হদ্দু খান
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

বড় ভাই হসু খাঁর মৃত্যুর পর হদ্দু খাঁ কিছুকালের জন্য গোয়ালিয়র ত্যাগ করে পৈতৃক নিবাস লক্ষ্ণৌতে চলে যান। শিগগিরই লক্ষ্ণৌতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কণ্ঠস্বর বড় ভাই হসু খাঁর মতো সুমিষ্ট না হলেও বেশ সুরেলা ছিল। গল্প প্রচলিত আছে গান করার সময় হঠাৎ জোরালো কণ্ঠে তান প্রয়োগ করলে আস্তাবলে বাঁধা – একবার তিনি একটি ঘোড়া বিকট চিৎকার করে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। কিছুকাল লক্ষ্ণৌবাসী থাকার পর গুজরাট রাজ্যের বরোদার মহারাজা সয়াজিরাওয়ের আমন্ত্রণে হদ্দু খাঁ গোয়ালিয়রে প্রত্যাবর্তন করেন।

মিয়াকি মালহার, ইমন, মালকোষ, তোরি বা টোড়ি, দরবারি-কানাড়া, বেহাগ ইত্যাদি রাগ হদ্দু খাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। গান করার সময় তিনি প্রথমে বিলম্বিত লয়ে শুরু করতেন। স্থায়ী এবং অন্তরা এই বিলম্বিত লয়ে। গাওয়ার পর বোলতান এবং বিভিন্ন প্রকার তান প্রয়োগ করতেন। তারপর একই রাগে একটি ছোট খেয়াল আরম্ভ করতেন এবং দ্রুতলয়ে তা পরিবেশন করতেন। তাঁর সপ্তকে ইচ্ছেমতো বিচরণ এবং সুরেলা কণ্ঠে স্পষ্ট তান প্রয়োগ ছিল তাঁর সংগীতশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

Music Gurukul logo of Gurukul Online Learning Network 350X70 V.02

ওস্তাদ হদ্দু খার অগণিত শিষ্যের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী গায়কের সংখ্যাই ছিল বেশি। ওস্তাদ হদ্দু খাঁ দুইবার বিয়ে করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত দুই পুত্র মুহম্মদ খাঁ ও রহমত খাঁ। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত দুই কন্যার মধ্যে অগ্রজের বিয়ে হয় ওস্তাদ ইনায়েত খাঁর সঙ্গে এবং ছোট মেয়ের বিয়ে হয় প্রসিদ্ধ বীণাশিল্পী ওস্তাদ বন্দে আলী খাঁর সঙ্গে। বৃদ্ধাবস্থায় ওস্তাদ হদ্দু খাঁর শরীরের নিচের অংশ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়। ওই অবস্থায়ও তাঁকে রাজদরবারে বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো গান গাওয়ার জন্য। মৃত্যুর এক মাস আগেও এই সংগীতসাধক প্রতিদিন নিয়মিত ছয় ঘণ্টা রেয়াজ করতেন। জীবনের গোধূলিলগ্ন পর্যন্ত সংগীতের সেবায় নিমগ্ন থেকে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে গোয়ালিয়রে তাঁর জীবনাবসান হয়।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment